অবিভক্ত বর্ধমান জেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম মানকর, অধুনা তা পূর্ব বর্ধমানে। মানকরের খ্যাতি কদমা বানানোর জন্য। বলা হয়, দেবী কালিকার বাঁ হাতে কদমা না দিলে নাকি মায়ের পুজো সম্পন্ন হয় না। এই মানকরে রয়েছেন আরেক বড় মা। মানকরের বড় মার পুজো পুর্ব বর্ধমান জেলা তথা বাংলার অন্যতম প্রাচীন কালী পুজো। জনশ্রুতি অনুযায়ী, সাধক রামানন্দ গোস্বামী বড়মার প্রতিষ্ঠা করেন। ৭০০ বছরের প্রাচীন এই দেবীকে নিয়ে নানান কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। লোকমুখে শোনা যায়, ক্ষ্যাপাকালী ও পঞ্চানন কালী হলেন বড়মা কালীর দুই বোন। তাঁরাও মানকরে পূজিতা হন। বাণীকণ্ঠ ঠাকুরের বংশধর সুদীপ ভট্টাচার্য্য ও সুশান্ত ভট্টাচার্য্যের উদ্যোগে মায়ের নতুন মন্দির তৈরি করা হয়েছে।
আজও রীতি মেনেই দেবীর পুজো হয়।
রামানন্দ গোস্বামী ছোটবেলা থেকে কালী মায়ের একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। দিনের বেশীর ভাগ সময়ে শ্মশানে থাকতেন তিনি। কাব্যতীর্থ পাশের পরই তিনি শক্তিসাধনা শুরু করেন। তাঁর বাবা কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ায়, পুত্রের এহেন কালী ভক্তি মোটেই পছন্দ করতেন না। কঠোর সাধনা করে মায়ের দর্শন পেয়ে ছিলেন রামানন্দ। কাশ আর বেত বনে ঘেরা শ্মশান ছিল তাঁর সাধনাক্ষেত্র। বর্তমানে যা মানকর ভট্টাচার্য পাড়া নামে পরিচিত। পরবর্তীতে সিদ্ধিলাভ করেন রামানন্দ। কথিত আছে সাধক রামানন্দ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ভক্তদের দাবি, রামকৃষ্ণ, বামাক্ষ্যাপাদের মতো তিনিও দেবীর সঙ্গে কথাও বলতেন।
বড় মা কালী নাকি তিন বোন। মেজ বোন মানকর ডাঙাপাড়ায় ক্ষ্যাপা কালী, আর ছোট বোন পাল পাড়ায় পঞ্চানন কালী। একদা সাধক রামানন্দ শ্মশানে ধ্যানে মগ্ন। পাড়ার কেউ তাঁর বাবাকে খবর দিয়েছেন। তাঁর বাবা শ্মশানে এসে কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাননি। শ্মশানের মধ্যে পঞ্চমুন্ডীর আসন প্রতিষ্ঠা করে মায়ের মন্দির তৈরি করেছিলেন রামানন্দ। ঠাকুর বাণীকণ্ঠ ভট্টাচার্যের হাতে তিনি মায়ের সেবার দায়িত্ব দেন পরবর্তীতে। বাণীকণ্ঠ ছিলেন মানকরের তৎকালীন জমিদার সদাশিব ভট্টাচার্যের বংশধর। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী, সাধক রামানন্দ তপস্যার দ্বারা সাতঘড়া জল এনেছিলেন। ওই জলে তাঁকে বড় মা কালীর মন্দিরে জীবন্ত সমাধি দেওয়া হয়েছিল।
ঠাকুর বাণীকণ্ঠ পুজো করতেন। সাধক রামানন্দ গোস্বামীর বড় মা কালীর ভোগেও বিশেষ বৈশিষ্ট রয়েছে। আটটি পৃথক উনুনে আট রকমের ডাল রান্না করে অন্নভোগের সঙ্গে নিবেদন করা হয়। রয়েছে নানান ধরনের তরকারি। কুড়ি সের এক পোয়া চালের অন্নভোগ রান্না হয় বড় মা কালীর ভোগের জন্য। শাক থেকে শুক্তো, মায়ের পুকুরের মাছ, গোবিন্দভোগ চালের পায়েস, ন'শলি চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। পাঁচ সের করে; মোট দশ সের ওজনের দুটি কদমা বলি দেওয়া হয়। এককালে পাঁঠাবলিও হত।
মন্দির ঘিরে জনশ্রুতির শেষ নেই। একদিন এক শাঁখারী মায়ের পুকুর পাড় দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একটি বাচ্চা মেয়ে তাঁর কাছে শাঁখা পরতে চায়। শাঁখারী দু-হাতে শাঁখা পরাতেই আরও দুটি হাত বাড়িয়ে দেয় মেয়েটি। শাঁখারী অবাক হলেও দুটি শাঁখা পরিয়ে টাকা চায়। মেয়েটি তখন উত্তরে জানায়, "মন্দিরের কুলুঙ্গিতে বেলপাতা ঢাকা দু-টাকা রাখা আছে ছেলেকে দিতে বলবি।" শাঁখারী সমস্ত কথা বাণীকণ্ঠ ঠাকুরের কাছে জানান। ঠাকুর, দু-টাকা দিয়ে শাঁখারীকে বলেন, তাঁর কোনও মেয়ে নেই। যে মেয়েটি শাঁখা পরেছে তাঁর কাছে নিয়ে চল। শাঁখারী বাণীকণ্ঠকে নিয়ে গেলেও মেয়েটিকে আর দেখা পাওয়া যায়নি। ঠাকুর বুঝতে পেরে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়েই মাকে শাঁখা দেখানোর অনুরোধ করেন। সন্তানের অনুরোধে মা কালী পুকুরের মাঝে চার হাত তুলে শাঁখা দেখায়। তারপর থেকে শাঁখারীর বংশধরেরা এখনও মায়ের পুজোয় শাঁখা দিয়ে যায়।
মা দুর্গার বিসর্জনের পর ত্রয়োদশীর দিন মায়ের কাঠামোয় মাটি পড়ে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বহু বছর আগে একবার এক প্রতিমাশিল্পী রাতে মায়ের চক্ষুদান করছিলেন। ওই সময় এক অদৃশ্য হাত পটুয়ার চুলের মুঠি ধরে বাইরে বের করে দিয়েছিল। মন্দিরের পাশে তাল গাছে তার মুখ ঘষে ফেলে দিয়েছিল। পরদিন সকালে স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে উদ্ধার করে। অন্যদিকে, মায়ের মুর্তিতে রক্তের দাগ দেখতে পাওয়া যায়। তখন থেকে আজ অবধি কোনও শিল্পী রাতে আর প্রতিমা গড়েন না। মায়ের প্রতিমা দিনে তৈরি করা হয়। জাগ্রত দেবী বড় মা কালীর মন্দিরে প্রতিবছর দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অসংখ্য ভক্ত।