বর্ধমান জেলার অন্তর্গত মঙ্গলকোট এই জেলার সবচেয়ে বড় প্রত্ন সমৃদ্ধ অঞ্চল। প্রাচীন এবং সম্পদশালী জনপদ।
বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রে মঙ্গলকোট নামক জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মঙ্গলকোট ‘আঠারো আওলিয়ার স্থান’ বলে পরিচিত। ওলি অর্থে ‘সাধুপুরুষ’। বহুবচন ‘আওলিয়া’।
মঙ্গলকোটে বিক্রমজিৎ নামে এক রাজা ছিলেন। অসম্ভব দক্ষ যোদ্ধাও। সেই সময় সতেরো জন মতান্তরে আঠারো জন গাজী মঙ্গলকোট দখল করতে আসেন। ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদে গাজীরা একে একে নিহত হন। শেষ পর্যন্ত ‘গজনবী’ নামে এক গাজী মঙ্গলকোট অধিকার করেন।
মঙ্গলকোটে এই আঠারো গাজীর সমাধি রয়েছে।গাজীদের নামও পাওয়া যায় ইতিহাসে। হাজি ফিরোজ, গোলাম পঞ্জতন, সৈয়দ শা তাজউদ্দীন, আব্দুল্লা গুজরাটী, মকদুম বিলায়েৎ, গজনবী প্রমুখ। পীর পঞ্জতনের মেলা আজও হয়ে আসছে মঙ্গলকোটে।
মঙ্গলকোট ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান বললেও বিশেষ ভুল হয় না।
মঙ্গলকোটের বহু স্থান থেকে পাল এবং গুপ্ত যুগের প্রত্ন সামগ্রী পাওয়া গিয়েছে। পাল যুগে বৌদ্ধ তন্ত্র সাধকরা উড্ডিয়ান এবং মঙ্গলকোষ্ঠ নামক বৌদ্ধ ধর্ম ক্ষেত্রের নাম অনুসারে বর্ধমানের দুই জনপদের নাম রাখেন মঙ্গলকোট এবং উজানি।
বিভিন্ন পুঁথি এবং শিলালিপি থেকে মঙ্গলকোটে তিনজন রাজার নাম পাওয়া যায়। শ্রীচন্দ্র সেন নামে এক রাজার নামও পাওয়া যায় হুসেন শাহ নির্মিত মসজিদে খোদিত লিপি থেকে। তবে অন্যত্র কোথাও উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
‘বক্রেশ্বর মাহাত্ম্য’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় এই অঞ্চলে শ্বেত নামে এক রাজা ছিলেন। দান ধর্মের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি। মঙ্গলকোট ছিল তাঁর রাজধানী।
হিন্দু এবং ইসলাম ধর্ম ছাড়াও বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের প্রভাব এবং নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।
এখানে গুপ্ত যুগের এক জৈন তীর্থঙ্করের দিগম্বর মূর্তি সন্ধান মিলেছিল।
খনন কার্য চালিয়ে বহু বৌদ্ধ মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।
মুসলিম আক্রমণের কারনে এই জনপদের স্থানীয় চরিত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটে। গিয়াসউদ্দীন খিলজির রাঢ় আক্রমণের সময় গঙ্গ সেনা এবং রাঢ় সেনাদের মধ্যে প্রবল সংঘাত হয়। তার প্রভাব পড়ে মঙ্গলকোটের ওপরও। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং ধর্মীয় স্থিতবস্থা ফিরে আসে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৬-৯০ সালের মধ্যে এই প্রত্নস্থলটিতে উৎখনন কার্য পরিচালনা করে।
সুলতানি এবং মোঘল আমলের মুদ্রার সন্ধান মিলেছে।
দুই জনপদই বাংলা তথা ভারতের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। মনসামঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত চাঁদ সওদাগর উজানি জনপদের অধিবাসী ছিলেন। কাব্যে ঘুরে-ফিরে এসেছে এই জনপদের কথা।
মঙ্গলকোটের চণ্ডীমঙ্গল পুজোয় ব্যবহৃত কাঠের সপ্তডিঙ্গা নৌ বাণিজ্যের কথা মনে করায়।