বাঙালির খাদ্যপ্রীতি কোন নতুন গজিয়ে ওঠা ঘটনা নয়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ থেকে সুভাষচন্দ্র বসু সকলেই ছিলেন ভোজনবিলাসী। মিষ্টিপ্রীতিতেও এঁরা কম যেতেন না। কথায় বলে, বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ, এই তেরো পার্বণের একটিও মিষ্টির অনুপস্থিতিতে সম্পূর্ণ হয় না। শেষ পাতে দই মিষ্টির হাজির বাধ্যতামূলক। বাংলায় যেকোন কাজে, অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ে; বাঙালির সব অনুষ্ঠানের মিষ্টির অবাধ প্রবেশ, এমনকি মৃতদেহ দাহ করে ফিরেও বাঙালির মিষ্টিমুখের রেওয়াজ বাংলায় বিদ্যমান বহুদিন ধরেই। আজকে বাংলার যেকোন মিষ্টির দোকানে রকমারী মিষ্টির আনাগোনা, নতুন পুরানো মিলিয়ে হরেকরকম মিষ্টি। এই মিষ্টির জয়যাত্রার শুরুটা কিন্তু এতো সুন্দরভাবে হয়নি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মিষ্টি ভিসা পেয়েছে। অনেক মিষ্টি ঠাকুর, ভক্তির হাতে ধরেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
তেমনই একটি মিষ্টি হল রসকদম্ব; রসকদম্ব নামের মিষ্টিটি তার অমৃত সমতুল্য স্বাদের জন্য প্রায় মালদহ জেলার সমার্থক হয়ে গিয়েছে। দুই বঙ্গে তার সমান জনপ্রিয়তা। পশ্চিমবঙ্গে মালদহ এবং পূর্ববঙ্গে রাজশাহী জেলা রসকদম্বের জন্য বিখ্যাত। জনশ্রুতি রয়েছে, সুলতান হুসেন শাহের আমলে মালদহ যখন গৌড় নামে পরিচিত ছিল সেই সময়ে এই গৌড়ে আসেন চৈতন্য মহাপ্রভু। কেলি কদম্ব বৃক্ষের নীচে তিনি রূপ অর্থাৎ রূপ গোস্বামী এবং সনাতন অর্থাৎ সনাতন গোস্বামীকে দীক্ষা দান করেন। এই কোলিকদম্ব বৃক্ষের নাম থেকেই মিষ্টিটির নাম হয় রসকদম্ব। রসকদম্ব দেখতে অনেকটাই কদম ফুলের মতো এবং ভিতরে মিষ্টি রসে ভরপুর। বৈষ্ণবরা এই ঘটনাকে সত্য মনে করেন এবং রসকদম্ব তাদের কাছে অমৃত স্বরূপ। ঐতিহাসিকেরা এই ঘটনাকে সত্য বলে মনে করেন না।
রসকদম্ব একটি প্রাক আধুনিক মিষ্টি, এর উৎসের কোনে তথ্যনির্ভর ইতিহাস পাওয়া যায় না। যদিও একে মনে করা হয় সুলতানি আমলের মিষ্টি। কিন্তু সুলতানি আমলের টাড়ার খাজা বা মনসকা হারিয়ে গেলেও রসকদম্ব, আজও আপন মহিমায় বাঙালির জিভে স্বর্গানুভূতি সৃষ্টি করেছে। মহাকালকে ভয় করে আজও গৌরবে অমলিন মালদহের রসকদম্ব। অবিকল কদম ফুলের মতো দেখতে রসকদম্বের ভিতরে থাকে ছোট একটি রসোগোল্লা। আর তার উপরে থাকে ক্ষীরের পুরু স্তর এবং সবচেয়ে বাইরের স্তরে থাকে চিনি মাখানো ভাজা পোস্তর দানা। এর মূল উপাদান হল ছানা, চিনি, ক্ষীর ও পোস্ত।
সর্বপ্রথম ছানা দিয়ে মাঝারি বা ছোট আকারে রসগোল্লা প্রস্তুত করা হয়, তারপর দানাদার তৈরি করার মতো করে রসগোল্লার থেকে বাড়তি রস ঝেড়ে ফেলা হয়। এই রসগোল্লার লাল রঙ যোগ করা হয়। হাল আমলে এতে ভ্যানিলা এসেন্সও দেওয়া হচ্ছে। এরপর সেই রসগোল্লাকে ক্ষীরের আস্তরনে ঢেকে ফেলা হয় এবং শেষে মাঝারি ভাজা পোস্তর আস্তরন দিয়ে সেজে ওঠে মালদহের জনপ্রিয় রসকদম্ব। মালদহের রাজমহল রোড, নেতাজি সুকান্ত রোড এবং মনোস্কামনা রোডের দোকানগুলিতে রসকদম্ব নিয়মিত পাওয়া যায়। মালদহের যেকোন রকম অনুষ্ঠানে এই রসকদম্বের চলে দেদার আনাগোনা। রাজ্য এবং দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বেশ কিছু বছর হল এই রসকদম্ব বিদেশেও পাড়ি দিয়েছে। ২০১৭ সালে কলকাতা রসগোল্লার ভৌগলিক সত্ত্ব লাভ করার পর মালদহবাসীও রসকদম্বের ভৌগলিক সত্ত্ব লাভে তৎপর হয়েছে। রসকদম্বের অপর নাম রসকদম। যদিও এর অপর দুটি রূপ বাঙালির মিষ্টির রসনায় পরিলক্ষিত হয়, প্রথম ক্ষীরকদম, এক্ষেত্রে সাদা রসগোল্লার বাইরে ক্ষীরের একটি স্তর ও তার বাইরে গুঁড়ো ক্ষীরের সর্বশেষ প্রলেপ দিয়ে এটি প্রস্তুত করা হয়। দ্বিতীয় পোস্তকদম, যা লালচে বাদামী রঙের হয়। অনেকটা রসকদম্বের সমবর্ণ এবং শুধুমাত্র পোস্তর একটি ঘন প্রলেপ থাকে। কিন্তু রসমদম্বের ক্ষেত্রে বাইরের আস্তরনটি হয় সাদা।
পোস্তর আস্তরন একে একটি মুচমুচে স্বাদ দেয় এবং তাতে কামড় বসালেই পাওয়া যায় রসে চুপচুপে রসগোল্লার অপূর্ব স্বাদ, যা রসকদম্বকে অনন্য করে তুলেছে।