লক্ষ্মী নারায়ণ বাংলায় বিভিন্ন নামে পূজিত হন। তেমনই হলেন লক্ষ্মী জনার্দন। মুকুট মনিপুরের লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির সকলের চেনা। কিন্তু কলকাতার কাছে শহরতলিতে রয়েছে এক লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির। গড়িয়া থেকে রাজপুরগামী অটোতে নরেন্দ্রপুর রথতলা নেমে চিন্তামণি কর পাখিরালয়ের পর বড় রাস্তা পেরিয়ে এই মন্দির রয়েছে।
পাঁচিলঘেরা এক মন্দির। শ্বেতপ্রস্তরের ফলকে লেখা, লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির, রামচাঁদ দে স্ট্রিট, দঃ জগদ্দল। প্রবেশপথের দুধারে রয়েছে থাম এবং তার ওপর অর্ধচন্দ্রাকৃতি খিলানে ফুল ও লতাপাতার কারুকার্য করা। দুপাশে চারটি থামের ওপর রয়েছে চারটি মূর্তি। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৈলাশ চন্দ্র দে বাংলার ১২৯৮ সনের ১ লা ফাল্গুন শুক্রবার, মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। মন্দিরের বয়স ১৩০ বছর অতিক্রান্ত। মন্দিরটি একতলা। চাতাল পেরিয়ে বেশ খানিকটা উঁচুতে মন্দির অবস্থিত। মন্দিরটি পূর্বমুখী। মন্দিরটি দালান রীতিতে তৈরি। মন্দিরের দুপাশে আটচালা আকৃতির চূড়া পরিলক্ষিত হয়, মন্দিরের দু-পাশে রয়েছে শিবলিঙ্গ। লক্ষ্মী জনার্দন বিগ্রহের উপরে রয়েছে ত্রিকোণাকৃতি চূড়া। মন্দিরে তিনটি গর্ভগৃহ রয়েছে। মাঝের গর্ভগৃহে কারুকার্যময় কাঠের সিংহাসনে অবস্থান করছেন শ্বেত পাথরের তৈরি লক্ষ্মী জনার্দনের মূর্তি। দুপাশের গর্ভগৃহে রয়েছে দুটি কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। একটির নাম কৈলাশেশ্বর আরেকটির নাম ভৈরবেশ্বর।
এবার গ্রাম বাংলার এক লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দিরের কথা বলব। পূর্ব বর্ধমানের দেবীপুরে রয়েছে লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দির। শিবতলা বাস স্ট্যান্ডে নামলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে এই মন্দিরে। জোড়া শিব মন্দির এবং দোল মঞ্চের বামদিকে সরু রাস্তা দিয়ে এগোলেই চোখে পড়বে বিশাল এক মন্দির। এটিই দেবীপুরের বিখ্যাত লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির। মন্দিরের উচ্চতা ৬০ ফুটে। মন্দিরটি ওড়িশার রেখ দেউল রীতিতে নির্মিত। মন্দিরের সামনের অংশ বাংলার নিজস্ব দোচালা মণ্ডপ রীতিতে নির্মিত। এখানেই বাংলা এবং ওড়িশার মন্দির স্থাপত্যের মেলবন্ধন ঘটেছে।
লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দিরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল পোড়ামাটির অলংকরণ। পোড়ামাটির কাজের মাধ্যমে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের জীবনকাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের জীবনের নানা কথা তুলে ধরা হয়েছে, কৃষ্ণের শৈশবের মাখন চুরির ঘটনা, কালীয় দমন লীলা, গোপীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা আবার মথুরা যাত্রার গল্পও স্থান সেখানে পেয়েছে। টেরাকোটার মাধ্যমে যুদ্ধের ছবিও তুলে ধরা হয়েছে।
এই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্যে ১৮৩৩ সালে জমিদার নরোত্তম সিংহের বর্ধমানের দেওয়ান বনবিহারী কাপুরের থেকে জমি কিনেছিলেন। জমিদার বাড়ির পরিবারিক কূল দেবতা ছিলেন লক্ষ্মী-জনার্দন। তাঁদের প্রতিষ্ঠা করার জন্যে তিনি মন্দির তৈরি করেছিলেন। নরোত্তম সিংহের প্রপৌত্র হেমন্ত গোপালের পুত্রবধূ কজ্জলীদেবী এবং তাঁর স্বামী দিব্যেন্দু নারায়ণ সিংহ, এই মন্দিরের আমূল সংস্কার করেন। মন্দিরের যে রূপপটি অধুনা বিদ্যমান, সেটি এই সময়ই তৈরি করা হয়েছিল। মন্দিরের পাশেই রয়েছে জমিদার বাড়ি। যদিও তার দশা একেবারেই জরাজীর্ণ। তবে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দির। আজও সেখানে পূজিত হন লক্ষ্মী-জনার্দন।