এবার পঙ্গপাল এসে বড়ো ক্ষতি করেছে। ক্ষিতিবাবুর ক্ষেতে একটি ঘাস নেই। অক্ষয়বাবুর বাগানে কপির পাতাগুলো খেয়ে সাঙ্গ ক’রে দিয়েছে। পঙ্গপাল না তাড়াতে পারলে এবার কাজে ভঙ্গ দিতে হবে। ঈশানবাবু ইঙ্গিতে বলেছেন, তিনি কিছু দান করবেন।”
শীতের মুখে আকাশে ঘন কালো মেঘ, কপালে ভাঁজ চাষির। কিন্তু এই মেঘে বৃষ্টি হয় না। মেঘ ভেসে আসে এক গাঁ থেকে আর এক গাঁয়ে। কোথা থেকে যে উদয় হয় কেউ বুঝতে পারে না, কিন্তু দেখা দিলেই হাত পা ঠাণ্ডা। গ্রামের মাথার ওপর, ক্ষেতের আকাশে এই মেঘ দেখা দেওয়া মানে অবশ্যম্ভাবী খাদ্যাভাব। অনাহার আর কষ্টের দিন গুজরান। মেঘের নাম পঙ্গপাল।
সহজ পাঠের শিশুপাঠে পঙ্গপাল আক্রান্ত গ্রামের কথা লিখেছিলেন রবি ঠাকুর আর সেই পাঠের অলঙ্করণে পঙ্গপালের ছবি এঁকেছিলেন নন্দলাল বসু। অনেকটা ঘাস ফড়িং-এর মতো দেখতে, কিন্তু মোটেই ঘাস ফড়িং-এর মতো নিরীহ নয়। যদিও এরা ফড়িঙ্গ গোত্রের পতঙ্গ। ছোট শুঁড়ওয়ালা বৃহত্তর এক জাতীয় কয়ার-ফড়িং।
এরা ঝোপঝাড় শস্যক্ষেত্রেই বিচরণ করে থাকে। শরীরের গঠন খুব মজবুত। পিছনের পা দেহের তুলনায় খুবই লম্বা এবং স্থুলাকার। দুই পায়েরই শক্তি অসাধারণ। এরা প্রায় দশ-বারো ফুট দূরে লাফিয়ে যেতে পারে। প্রায়ই এরা গাছ বা লতাপাতার উপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। নেহাৎ দায়ে পড়লে উড়ে যায়। তবে উড়তে তত পটু নয়। ঘাসপাতা, ফুল-ফল খেয়েই ওরা জীবন ধারণ করে। আমাদের দেশীয় প্রকৃত পঙ্গপাল জাতের কয়ার-ফড়িংগুলি প্রায় দু-ইঞ্চি থেকে আড়াই-ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এরা সংখ্যায় অপেক্ষাকৃত কম। কয়ার–ফড়িংই শরীরের পশ্চাদ্ভাগের সাহায্যে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে ডিম পাড়ে।
পঙ্গপাল ত্রাস।ঝাঁকে ঝাঁকে রাক্ষুসে পতঙ্গ উড়ে এসে সাবাড় করে দেয় ক্ষেত, ফসল। কিছুই অবশিষ্ট রাখে না।
আগেকার দিনে গ্রামে পঙ্গপালের দেখা পেলে মানুষ বাজনা, বাদ্যি, ক্যানেস্তারা বাজিয়ে পঙ্গপাল ঝাঁকের দিক পরিবর্তনের চেষ্টা করত। পঙ্গপাল একবার প্রবেশ করলে কোথাও কিছুমাত্র সবুজ অবশিষ্ট থাকত না। ১০ লাখ পতঙ্গের একটি ঝাঁক একদিনে ৩৫ হাজার মানুষের খাবার খেয়ে ফেলতে পারে। কেবল খাবারই খায় না তারা, একই সঙ্গে প্রজননও করে।
১৯২০ সালে পঙ্গপালের আক্রমণে প্যালেস্টাইন প্রায় শ্মশানে পরিনত হয়ে গিয়েছিল।২০২০ সালে ভারতে ফিরে এসেছিল পঙ্গপাল আতঙ্ক। অতিমারীর দুর্যোগের মধ্যে বিভীষিকা বয়ে এনেছিল পঙ্গপাল আক্রমণের খবর। রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, বিহার হরিয়ানা থেকে এসেছিল পঙ্গপালের খবর। পঙ্গপাল তাড়াতে ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল। ভারতই প্রথম দেশে যার পঙ্গপাল মোকাবিলায় ড্রোন ব্যবহার করেছিল।
কীটনাশক স্প্রে দিয়ে পঙ্গপাল মোকাবিলা করা যায় না। খুব দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে এরা। পঙ্গপালকে আটকাতে পুড়িয়ে ফেলার কৌশল নেওয়া হত। পঙ্গপালর গতির নিরিখে আড়াআড়িভাবে লম্বা লম্বা গভীর নালা কেটে রাখা হয়। তাড়া খেয়ে এরা দলে দলে গর্তের মধ্যে পড়ে স্তূপীকৃত হতে থাকে। তখন কেরোসিন প্রভৃতি পদার্থের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অনেক জায়গায় আবার গভীর গড়খাইয়ের মধ্যে মসৃণ টিনের পাতের লম্বা পাত্র নালার মধ্যে সাজিয়ে রাখা হয়। পঙ্গপালেরা তার নীচে পড়ে গেলে টিনের মসৃণ গা বেয়ে উপরে উঠে আসতে পারে না। তখন সেগুলিকে ক্রেনের সাহায্যে উপরে তুলে বস্তাবন্দি করে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়।
তবে ২০২০ সালেই একটি নতুন আবিষ্কার পঙ্গপাল প্রতিরোধে নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। চাইনিজ় অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এর এক দল বিজ্ঞানী খোঁজ চালিয়েছিলেন কেন দল বাঁধে পঙ্গপাল। সেই খোঁজ করতে গিয়েই সামনে আসে পতঙ্গ প্রতিরোধের সম্ভাব্য উপায়। নেচার পত্রিকাতে প্রকাশিত হল তাঁদের সেই আবিষ্কার।
পঙ্গপাল যখন একক ভাবে থাকে তখন সে খুব বিপজ্জনক নয়, কিন্তু তারা যখন দলবদ্ধ হয়ে বিচরন করে তখনই বিপদ। পঙ্গপালের দেহ থেকে নিঃসৃত হয় ফেরোমেনন নামে একরকম পদার্থ। তারা ফেরোমেননের জন্যই দল বাঁধে।
পঙ্গপালের অ্যান্টেনায় থাকা গ্রাহক প্রোটিন ভাসমান ৪-মিথক্সি স্টাইরিনের সঙ্গে যুক্ত হয়। নাম ওআর৩৫। রিসেপটরগুলি এর পরে বিশেষ কোষগুচ্ছকে উত্তেজিত করে। ফল ফেরোমন নিঃসরণ। পরীক্ষাগারে জিন প্রযুক্তির সাহায্যে এমন ধরনের পঙ্গপাল বানানো হয়েছে, যার ওআর৩৫ প্রোটিনটি অকেজো। ফেরোমন ট্র্যাপের মাধ্যমে পঙ্গপালের ঝাঁককে আকৃষ্ট করে এপঙ্গপাল দল নিধন করা সম্ভব হবে।
ইলিয়ড ওডিসি থেকে শুরু করে বাইবেল সবেতে উল্লেখ আছে এই পতঙ্গের। কোনও কোনও দেশে আবার পঙ্গপাল খাদ্য হিসেবেও জনপ্রিয়। এমন কি ডাকটিকিটও প্রকাশ করা হয়েছে পঙ্গপালের।আছে মুদ্রাও।