কালীক্ষেত্র বীরভূম জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক কালী মন্দির। আজকের কালী কথায় বীরভূমের এক স্বল্প আলোচিত কালী মন্দিরের কথা, তবে সেই মন্দিরের ইতিহাসও কিছু কম নয়। বীরভূমের দুবরাজপুরের লোবা পঞ্চায়েতের লোবা গ্রামের লোবা কালী মন্দিরের কথা আজকের কালী কথায়। মন্দিরে রয়েছে মা কালীর মৃন্ময়ী মূর্তি। দেবী এখানে দক্ষিণা কালী, চতুর্ভুজা, মুণ্ডমালিনী, এলোকেশী। মন্দিরের সামনেই রয়েছে প্রায় পাঁচশো বছরের পুরোনো পঞ্চমুণ্ডির আসন। এখানে মা হলেন স্থানেশ্বরী, তিনি যে রূপে ভূখণ্ডকে রক্ষা করেন, সেই অনুযায়ীই দেবীর নাম আর সেই ভূখণ্ডের নাম হয়েছে। লোবা গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী মায়ের নাম লোবা কালী বা দেবী লোবা।
শোনা যায়, সিদ্ধ তান্ত্রিক রামেশ্বর দণ্ডী এই কালী পুজো শুরু করেছিলেন। তিনি নিজেই মূর্তি তৈরি করে, পুজো করতেন। পুজোর পর মূর্তির বিসর্জন দিতেন। কাশীবাসী হওয়ার আগে রামেশ্বর দণ্ডী লোবা গ্রামের ঘোষ ও চক্রবর্তী পরিবারের হাতে পুজোর দায়িত্ব দিয়ে যান। লোবা মায়ের বেদীতে থাকে শিলাখণ্ড। সেটি সারাবছর ধরে পুজো করা হয়। পুকুর থেকে শিলাখণ্ড পাওয়া গিয়েছিল। সূর্যোদয়ের পর থেকে মায়ের বেদি থেকে না নামা পর্যন্ত পুজোর দায়িত্ব থাকে চক্রবর্তী পরিবারের সদস্যদের হাতে। বেদী থেকে মাকে নামানোর পর দায়িত্ব চলে যায় ঘোষ পরিবারের হাতে। লোবা গ্রামের এই কালী মা ঘোষ পরিবারের মেয়ে হিসাবেই বছরের পর বছর পূজিত হচ্ছে। মন্দিরের বয়স প্রায় তিনশো বছর। এই কালীপুজো লোবা মায়ের পুজো হিসেবেই খ্যাত। প্রাচীন এই পুজোকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে রয়েছে নানান কাহিনি। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় এই পুজোয় সামিল হয়।
কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যায় এখানে মহাসমারোহে কালীপুজো হয়। নানান প্রান্ত থেকে ভক্তরা এই মন্দিরে আসেন। এছাড়াও প্রতি অমাবস্যায় পুজো হয়। কথিত আছে, দেবী লোবা না ডাকলে, ভক্তরা মন্দিরে আসতে পারেন না। এই পুজোকে কেন্দ্র করে ফি বছর মেলার আয়োজন করা হয়, রীতি মেনে পাশের গ্রামের মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়ে ও জামাইদের আমন্ত্রণ জানাতে হয়। উপহার বিনিময়ের রেওয়াজও রয়েছে।
দীপান্বিতা অমাবস্যার পরদিনই স্থানীয় কালিভাসা পুকুরে দেবীর বিসর্জন করা হয়। বিসর্জনের সময় এখানে তিনটি কালী প্রতিমা একসঙ্গে বিসর্জন করা হয়। এই তিন কালী প্রতিমাকে তিন বোন হিসাবে গণ্য করা হয়। তিন গ্রামের তিন দেবী হলেন তিন বোন। লোবা মা হলেন বড় বোন, বাবুপুরের মা মেজো বোন এবং বরাড়ির মা ছোট বোন।
মূর্তি তৈরিতেও রয়েছে বিশেষত্ব, মায়ের মূর্তি গড়ার জন্য বাগদি সম্প্রদায়ের মানুষের আনা মাটি ব্যবহার করা হয়। মাটি আনা হয় বর্ধমান জেলার গৌড়বাজারের তালপুকুরের ঈশান কোণ থেকে। বাগদি সম্প্রদায়ের মানুষরা মাথায় করে মাটি নিয়ে আসেন। দুর্গাপুজোর পর একাদশী থেকে শুরু হয় মায়ের মূর্তি গড়ার কাজ। মূর্তি গড়তে কাঠামো তৈরির জন্য, বাবুই দড়ি লাগে, যা বংশপরম্পরায় যোগান দেন বাউরি পরিবারের সদস্যরা। মূর্তি তৈরির কাজে হাত লাগান সূত্রধর পরিবারের সদস্যরা। মায়ের রঙ করা হয় সম্পূর্ণ ভেষজ রঙে। কালীপুজোর দিন মূর্তি তৈরির পর ঘোষ পরিবারের সদস্যরা মাকে অলংকার পরিয়ে পুরোহিতদের হাতে তুলে দেন। পুজোয় প্রদীপ জ্বালানোর জন্য যে ঘি ব্যবহৃত হয় তা বংশপরম্পরায় সরবরাহ করেন গোয়ালারা। নিশিরাতে পুজো শুরু হওয়ার পর, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেবীর দায়িত্ব নেন স্থানীয় ধীবররা।
তবে, লোবা মা একা পূজিত হন না। এখানে তিন মায়ের পুজো হয় একসঙ্গে। পুজোর নির্ঘণ্ট ও বিসর্জনের সময়ও এক। লোবার তিন মা বড় মা, মেজো মা ও ছোট মা; তিন মা-ই খুব জাগ্রত। শতাধিক বছর আগে থেকে এই রেওয়াজ চালু। লোবার প্রতিমা নিরঞ্জনও খুবই আকর্ষণীয়। কাঁধে করে একসঙ্গে তিন মায়েরই বিসর্জন হয়।
লোবা মায়ের বেদীতে রয়েছে শিলাখণ্ড। সেটি সারাবছর পুজো করা হয়। পুকুর থেকে শিলাখণ্ডটি পাওয়া গিয়েছিল। সূর্যোদয়ের পর থেকে মায়ের বেদি থেকে না নামা পর্যন্ত পুজোর দায়িত্ব থাকে চক্রবর্তী পরিবারের হাতে। বেদী থেকে মাকে নামানোর পর দায়িত্ব চলে যায় ঘোষ পরিবারের কাছে। লোবা গ্রামের দেবী কালী ঘোষ পরিবারের মেয়ে হিসেবেই বছরের পর বছর পূজিতা হচ্ছে।
কথিত আছে, বহু মানুষ লোবা কালীর মন্দিরে এসে জীবনের পথ খুঁজে পেয়েছেন। মনস্কামনা পূরণ হয়েছে। আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। বলা হয়, এই মন্দিরে প্রার্থনা করলে আর্থিক সমস্যা মেটে। গ্রামের মানুষের কাছে দেবী লোবা ভরসার কেন্দ্রস্থল।