কালী কথা: বাঁকুড়ার লক্ষ্যাতড়া মহাশ্মশানে পুরোহিতের রক্তে পূজিতা হতেন দেবী কালী

শ্মশান কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম বিদ্যা, কালী বা কালিকার এক রূপ। শ্মশান কালী অঞ্জন পর্বতের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ শুস্ক শরীরবিশিষ্টা। দেবী শ্মশান কালিকা রক্তিমাভ চক্ষু বিশিষ্টা, কেশ আলুলায়িত। দেবীর ডান হাতে সদ্য ছিন্ন নরমুণ্ড ও বাম হাতে আসবপূর্ণ নরমুণ্ড নির্মিত পানপাত্র। দেবী সর্বদা ক্ষুৎ পিপাসান্বিত ও শবরূপী সদাশিবের উপর দন্ডায়মানা। কপালে অর্ধচন্দ্র শোভিতা। আজকের কালী কথায় বাঁকুড়ার বিখ্যাত শ্মশান কালী পুজোর কাহিনি, যা লক্ষ্যাতড়া মহাশ্মশানের কালীপুজো নামে পরিচিত। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো এই কালীমন্দিরের কালী খুবই জাগ্রত। কয়েকজন সাধক মিলে এই কালীপুজোর সূচনা করেছিলেন৷ তখন থেকে বাঁকুড়ার লক্ষ্যাতড়া মহাশ্মশানে কালী পুজো চলছে। বাঁকুড়ার এই কালীপুজো ঘিরে ফি বছর উৎসবে মেতে ওঠেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বাঁকুড়া শহরের প্রাচীন এই মহাশ্মশানের কালীপুজো মহাধুমধামে আয়োজিত হয়। অলোক সজ্জায় সেজে ওঠে গোটা মন্দির চত্বর। থাকে থিম।

বাঁকুড়া শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে গন্ধেশ্বরী নদী, গন্ধেশ্বরীর পাশেই অবস্থিত লক্ষ্যাতড়া মহাশ্মশান। একদা দূরদূরান্ত থেকে সাধুরা এই শ্মশানে এসে পুজো করতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবীরাও এই পুজোয় অংশ নিতেন। দীর্ঘদিন ধরেই এখানে তিনটি কালী প্রতিমার পুজো হয়। শ্মশানে মৃতদেহ সৎকারের সঙ্গেই চলে পুজোর আয়োজন। তন্ত্রমতে পুজো হয়। কালী প্রতিমা পাথরের। পুজোর আগে প্রতিমার অঙ্গরাগ হয়, রঙের প্রলেপ পড়ে। পুরোহিত নিজের হাত কেটে রক্ত দিয়ে মায়ের পুজো করেন বলেও জানা যায়। দেবীর ভোগে মাছ, মাংস ও মদ নিবেদন। বলিদান করা হয়।

এই কালীপুজোয় শুশুনিয়া পাহাড়ের ঝর্ণার জল নিয়ে আসেন ভক্তরা। পুজোর দিন ভোরবেলায় পাঁচবাগা এলাকা থেকে শোভাযাত্রা করে ঘট নিয়ে আসেন ভক্তরা। দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপুজোয় বিপুল ভক্ত সমাগম হয়। হাজার হাজার ভক্ত প্রাসাদ খেতে ভিড় করেন। দেবীকে সোনা ও রুপোর নানা গয়না পরানো হয়। মায়ের পুজো উপলক্ষ্যে শ্মশানের বাইরে মেলা বসে। 

স্বাধীনতার আগে এখানে বিপ্লবীদের গোপন আখড়া ছিল। তাঁরাই সেখানে পুজো করতেন। পরে আরও দুটি মন্দির হয়েছে। বাঁকুড়ার লক্ষ্যাতড়া মহাশ্মশানে একই সঙ্গে এখন চার কালী পূজিতা হন।

লক্ষ্যাতড়া মহাশ্মশানে ভবতারিণীর পুজো হয়, এছাড়াও পূজিতা হন শ্মশানকালী, ভৈরবী কালী ও তারা মা। এখানকার প্রাচীন মন্দিরটি দেবী ভবতারিণীর। মা ভবতারিণীকে খিচুড়ি, ফল, পরমান্ন ভোগ দেওয়া হয়। বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। অন্যদিকে, শ্মশানকালীর পুজো হয় তন্ত্রমতে। দেবীকে মাছ, মাংস ও কারণ প্রসাদ হিসেবে দেওয়ার রীতি রয়েছে। এছাড়া চাল কুমড়ো, আখ ও ছাগ বলির চলও রয়েছে।পৃথক চার মন্দিরে চারজন পুরোহিত পুজো করেন। মন্দিরে চলে নিত্যপুজো। এখানকার পুজোর অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য হল ভবতারিণী, কালী, ভৈরবী ও মা তারার পুজো এক সঙ্গে হয়। এখানকার বড় মন্দিরের কালী মূর্তি সুদূর বেনারস থেকে আনা হয়েছিল।

শতাধিক বছর আগে নদীর পারের শ্মশানে সাধুরা পুজোর সূচনা করেছিলেন। চালাঘরে হ্যাজাকের আলো জ্বেলে পুজো হত। সময়ের সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁগা লেগেছে পুজোয়। ধাপে ধাপে মন্দিরের সংখ্যা বেড়েছে। কংক্রিটের মন্দিরেই এখন দেবীর পুজো হয়। মা ভবতারিণী, মা কালী, মা ভৈরবীর, মা তারার মন্দিরের পাশাপাশি বামা ক্ষ্যাপা ও লোকনাথ ব্রহ্মচারী, হনুমান মন্দির সহ বেশ কিছু মন্দির। 

স্থানীয়দের বিশ্বাস, শ্মশান কালীর পুজোর সঙ্গে যাঁরা যুক্ত থাকেন; তাদের ব্যবসায়িক বা অন্য কোনও ক্ষেত্রে কোনওদিন সমস্যা হয় না।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...