আজকের কালীকথায় নবাবের জেলার এক কালী মন্দিরের কথা। এই জেলাতেই বিরাজ করছেন দেবী কিরীটেশ্বরী। তবে আজ জানবো লালগোলার রাজাদের কালীবাড়ির কথা। মন্দিরটি আজ লালগোলা তথা মুর্শিদাবাদ জেলার পুরা সম্পদ। এই কালীবাড়িতে আসতেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম, সাহিত্যিক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদির মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিরা। শোনা যায়, শেকলবাঁধা কালীমূর্তি দেখেই সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বন্দেমাতরম রচনা করেন। বঙ্কিম আনন্দমঠ উপন্যাসও এখানে বসেই লেখেন। মন্দিরের মা কালীকে দেখেই স্বাধীনতার বীজমন্ত্র তৈরি হয়েছিল।
এই মন্দিরে দেবীর সামনে বসেই কাজি নজরুল ইসলাম অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীত গেয়েছিলেন। লালগোলা কালীবাড়ির কালী মূর্তির মতোই একটি কালীমূর্তি পুজো করতেন লালগোলার দেবীনগর গ্রামের চাঁই মণ্ডল সম্প্রদায়ের মানুষজন। বর্ধমানের কাটোয়ার মণ্ডল গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের কূলদেবী ছিলেন তিনি। কোনও কারণে সেই পরিবারের পুজো বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় আড়াইশো বছর আগে সেই পরিবারের এক পুরুষ সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করে গৃহত্যাগী হন। তিনি ঘুরতে ঘুরতে দেবীনগর গ্রামে এসে উপস্থিত হন এবং এখানে পারিবারিক কালীমূর্তিটি নতুন করে প্রতিষ্ঠা করে মাতৃ আরাধনা শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পর চাঁই মণ্ডলরা সেই পুজো চালিয়ে যেতে থাকেন। লালগোলার তৎকালীন রাজা রাও রামশংকর রায় দেবীনগর গিয়ে সেই মূর্তির দেখা পান। সে'সময় মূর্তিটি একটি গাছের তলায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করার জন্য গ্রামবাসীরা রাজাকে আবেদন করেন। কিছুকাল পর পদ্মার গ্রাসে সমস্ত দেবীনগর গ্রামটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মাতৃমূর্তির কাঠামোটি পদ্মার শাখা নদী কলকলিতে প্রবাহিত হয়ে লালগোলা রাজবাড়ির ঘাটে এসে পৌঁছয়।
শোনা যায়, রাজা রামশংকর স্বপ্নাদেশ পান মা কালী স্বয়ং তাঁর গৃহে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইছেন। পরদিন ভোরে ঘাটে কাঠামো এসে পৌঁছলে কাঠামো তুলে রাজবাড়িতে নিয়ে আসা হয়। রাজা রামশংকর রায় কাটোয়ার মণ্ডল গ্রামে লোক পাঠান ভট্টাচার্য পরিবারকে খুঁজতে। ভট্টাচার্য পরিবারের খোঁজ মেলে। মহারাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ রায়ের সভাপণ্ডিত ত্রৈলোক্য ভট্টাচার্যের পিতামহ আসেন। তিনি ছিলেন সিদ্ধ সাধক। রাজা তাঁর কাছে মন্দির প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
পন্ডিত তৈলক্ষ ভট্টাচার্য জানান তাঁদের প্রতিষ্ঠিত মা, যা ডাকাতেরা তুলে নিয়ে গিয়ে দেবিনগর গ্রামে পুজো করছিলেন সেই মায়ের তাঁরা চার শরিক। বাকি তিন শরিকের নাম ছিল সুরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য, পঞ্চানন ভট্টাচার্য ও অমর ভট্টাচার্য। তাঁরা প্রত্যেকেই বর্ধমান জেলার কাটোয়ার মন্ডল গ্রামের বাসিন্দা। রাজা রাম শংকর রায় পন্ডিত তৈলক্ষ ভট্টাচার্যর পরামর্শে মন্দির গড়েন। প্রত্যেক শরিককে তিন মাস করে পুজো করবেন এই মর্মে ভট্টাচার্যদের মন্দিরে পুরোহিত হিসেবে রাখেন। শুরু হয় লালগোলার কালী মায়ের আরাধনা।
শুরু হয় মূর্তি তৈরির কাজ। লালগোলার মাতৃমূর্তিতে মা নৃত্যরতা মহাকালী রূপে শবরূপ মহাদেবের উপর দণ্ডায়মান। তার এক পাশে মহালক্ষ্মী, অপর পাশে মহাসরস্বতী, দক্ষিণে কামদেব বা পুরুষ এবং বামে রতিদেবী বা প্রকৃতি। দক্ষিণে অপরাজিতা জয়া, বামে অজিতা বিজয়া। চণ্ডীর ঋষিচ্ছন্দস্ত্রমের সঙ্গে এই মূর্তির মিল পাওয়া যায়।
জনশ্রুতি রয়েছে, প্রতিষ্ঠার রাতে মা কোনও কারণে অসন্তুষ্ট হন। রাজাকে স্বপ্নাদেশে তিনি জানান মন্দির ত্যাগ করবেন। রাজা তখন ক্রোধবশত মায়ের মূর্তিকে পেছন থেকে লোহার শেকলে বেঁধে দেন।
ইতিহাস বলে, ১৮১৩ সালে লালগোলা রাজ কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভূ-ভারতে এমন মাতৃমূর্তি আর দ্বিতীয় নেই। ভক্তদের বিশ্বাস মন্দিরের মা অত্যন্ত জাগ্রত। তিনি সকলের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন।