১৯০১ সালে বেলুড় মঠে কুমারী পুজো আরম্ভ করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। মা সারদার উপস্থিতিতে ৯ জন কুমারীকে পুজো করেছিলেন তিনি। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিনে অন্যতম আকর্ষণ হল কুমারী পুজো। মাতৃ আধারনায় কুমারী পুজোর চল বহুদিনের। কালীপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজো, অন্নপূর্ণাপুজো সময়ও কুমারী পুজো দেখা যায়। বেলুড় মঠের কুমারী পুজো খুবই বিখ্যাত। বারোয়ারি পুজো থেকে বনেদি পুজো সর্বত্রই কুমারী পুজোর চল রয়েছে। বিশ্ব ব্রহ্মণ্ডে প্রতিনিয়ত স্থিতি, স্থিতি ও লয় চলছে, এই তিন শক্তিই নিহিত রয়েছে নারীর মধ্যে। এই কুমারীই নারী জাতির প্রতীক। তাই কুমারীকেই বিশ্বজননী রূপে দেবীজ্ঞানে পুজো করা হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর প্রকাশ।
প্রচলিত পৌরাণিক ইতিহাস অনুসারে, কোলাসুরকে বধ করার মধ্যে দিয়ে কুমারী পুজোর প্রচলন শুরু হয়। কোলাসুর একসময় স্বর্গ ও মর্ত্য অধিকার করে নিলে দেবকুল মহাকালীর শরণাপন্ন হয়। দেবতাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। তারপর থেকেই কুমারী পুজোর প্রচলন হয়। দেবীজ্ঞানে যেকোন কুমারীকেই পুজো করা যায়। সেকালে মুনিঋষিরা কুমারীপুজোর মাধ্যমে প্রকৃতিকে পুজো করতেন। প্রকৃতি মানেই নারী। মহাভারতের যুগ থেকেই কুমারী পুজোর প্রচলন হয়েছিল। অর্জুনের কুমারী পুজো করার বিবরণও পাওয়া। দেবী পুরাণে কুমারী পুজোর সুষ্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। নিয়ম অনুসারে পুজোর জন্য কুমারীর বয়স হতে হবে ১ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। বয়স ভেদে কুমারীর নাম হয় ভিন্ন। এক বছরের কুমারী নাম হয় সন্ধ্যা। দুই বছরের কুমারী সরস্বতী, তিন বছরের কুমারী ত্রিধামূর্তি, চার বছরের কুমারী কালিকা, পাঁচ বছরের কুমারী সুভগা, ছয় বছরের কুমারী উমা, সাত বছরের কুমারী মালিনী, আট বছরের কুমারী কুষ্ঠিকা, নয় বছরের কুমারী কালসন্দর্ভা, দশ বছরের কুমারী অপরাজিতা, এগারো বছরের কুমারী রূদ্রাণী, বারো বছরের কুমারী ভৈরবী, তেরো বছরের কুমারী মহালপ্তী, চৌদ্দ বছরের কুমারী পীঠনায়িকা, পনেরো বছরের কুমারী ক্ষেত্রজ্ঞা, ষোলো বছরের কুমারী অন্নদা বা অম্বিকা।
চিরাচরিত রীতি মেনে মৃন্ময়ী উমার সঙ্গেই পূজিতা হন কুমারী। ১৯০১ সাল থেকেই বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো ও একই সঙ্গে কুমারী পুজোর সূচনা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এক দিন বেলুড় মঠে বেলগাছ তলায় বসে স্বামী বিবেকানন্দ দেখেন, নৌকা থেকে নেমে মা দুর্গা বেলুড় মঠে প্রবেশ করছেন। তারপরে স্বামীজি স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে মঠে দুর্গাপুজোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দও তাঁকে জানান, তিনিও মা দুর্গাকে বেলুড় মঠে প্রবেশ করতে দেখেছেন। তার পরেই মঠে দুর্গাপুজোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু হাতে সময় অল্প, কোথায় পাওয়া যাবে প্রতিমা, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিল। কুমোরটুলিতে গিয়ে প্রতিমার খোঁজ চলল। কিন্তু কুমোরটুলির কোনও শিল্পীই নতুন করে প্রতিমা গড়তে রাজি হলেন না। তখন এক পটুয়া জানান, সেই বছর তাঁর তৈরি সব প্রতিমার মধ্যে যেটি সবচেয়ে সেরা, সেটি এক ব্যক্তি বায়না করে গিয়েছেন। তিনি যদি শেষ পর্যন্ত না নেন, তাহলেই প্রতিমাটি দেওয়া যাবে। ওই ব্যক্তি প্রতিমাটি নেননি, তখন সেই প্রতিমা বেলুড় মঠে এনে পুজো করা হয়। প্রথম বছরের পুজোয় মঠে উপস্থিত হয়েছিলেন মা সারদা। তাঁরই নামে পুজোর সঙ্কল্প হয়েছিল। এইভাবেই বেলুড় মঠের পুজো শুরু।
বেলুড় মঠের দুর্গা পুজোর অন্যতম আকর্ষণ হলো কুমারী পুজো। অষ্টমীর দিন সকালে এক কুমারীকে গঙ্গাস্নান করিয়ে, গায়ে গয়না, পায়ে আলতা, কপালে চন্দন, হাতে পদ্ম ফুল, লাল বেনারসি পরিয়ে দেবী রূপে সাজানো হয়। ওই কুমারীর মধ্য দিয়েই খোঁজা হয় দেবী দুর্গাকে। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবনা থেকেই বেলুড়ে কুমারী পুজোর শুরু। বেলুড় মঠের কুমারী পুজোর সঙ্গে মিশে রয়েছে ইতিহাস। এখানে পুজোর সময় খেয়াল রাখা হয় অভুক্ত থেকে কুমারী যেন কষ্ট না পান। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, পূজিতা কুমারী খাবার খেলে তা বিশ্ব ভুবনকে খাওয়ানো হয়। পাশ্চাত্য দেশে স্বামীজী দেখেছিলেন নারীদের প্রতি সমাজের উদার এবং আধুনিক মানসিকতা। কিন্তু দেশের তৎকালীন হিন্দু সমাজ বিবেকানন্দের পশ্চিমী মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি। বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো তথা কুমারী পুজো আয়োজন করে স্বামীজি দেবী দুর্গার আরাধনা ও কুমারী পুজোর মাধ্যমে এ দেশের নারীদের প্রতি অবহেলা ও প্রাচীন মানসিকতা দূর করতে চেয়েছিলেন।
তবে স্বামীজি আরও আগে কুমারী পুজো করেছিলেন। ততদিনে তার বিশ্বজয় হয়ে গিয়েছে। তিনি তখন কাশ্মীরে, হঠাৎই এক ঘটনা দেখে চিৎকার করে বলে উঠলেন, সিস্টার আমি পেয়ে গিয়েছি। নিবেদিতা চমকে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, স্বামীজি জবাবে বললেন, তিনি মা দুর্গাকে পেয়ে গিয়েছেন। তারপর নিবেদিতার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, যে মেয়েটা নিজের মুখের খাবার, হাসতে হাসতে ভাইয়ের মুখে তুলে দিতে পারে যুগ যুগ ধরে সেই তো আমার মা দুর্গা। সেই তো আমার ভারত মাতা। নিবেদিতাকে পুজোর উপকরণের আয়োজন করার নির্দেশ দিলেন। সঙ্গে বললেন, আগামীকাল দুর্গাপুজোর অষ্টমীতে ওই মেয়েটিকে তিনি ক্ষিরভবানী মন্দিরে দুর্গার আসনে বসিয়ে কুমারীপুজো করবেন। স্বামীজির পথ আটকালো কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন কাশ্মীরি পণ্ডিত। তাদের বক্তব্য, স্বামীজি ভুল করতে যাচ্ছিলেন, ওই মেয়েটিকে কখনওই তিনি দুর্গা রূপে পুজো করতে পারেন না। মেয়েটির জন্ম মুসলমান ঘরে। তার বাবা একজন মুসলমান শিকারা চালক। এই কথা শুনে স্বামীজি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন মা দুর্গাকে হিন্দু আর মুসলমানের পোশাক দিয়ে চেনেন। আমি আমার মা দুর্গাকে অন্তরাত্মা দিয়ে চিনি। ওই মেয়েটিই আমার মা দুর্গা। আগামীকাল ওকেই আমি দুর্গার আসনে বসিয়ে পুজো করব। দুর্গাপুজোর অষ্টমী তিথিতে ক্ষিরভবানী মন্দিরে প্রথম কুমারী হিসেবে পূজিত হয়েছিল এক কাশ্মীরি মুসলমান মেয়ে। পুজো করেন বিবেকানন্দ। পুজোর জোগাড়জান্তির দায়িত্বে ছিলেন নিবেদিতা।