কালীক্ষেত্র বীরভূমেও বিরাজ করেন দেবী ভবতারিণী কালী, আজ তাঁর কাহিনি কালী কথায়। বীরভূমের সিউড়িতে রয়েছে ভবতারিণী কালী, বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিন দেবীর বাৎসরিক পুজো হয়। মন্দিরের বয়স প্রায় দেড়'শো বছর। মন্দিরটি মা ভবতারিণী কালী মন্দির নামেই খ্যাত। মল্লভূম বিষ্ণুপুরের দেওয়ান ও শক্তিসাধক চণ্ডীচরণ মুখোপাধ্যায়ের পৌত্র কুলদানন্দ দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর বিগ্রহের আদলে মূর্তি নির্মাণ করিয়ে সিউড়িতে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দিনটি ছিল ১২৮৩ বঙ্গাব্দের, ৩০ চৈত্র। ইংরেজির ১৮৭৬ সাল। প্রতিদিন ভোর ৫টায় মন্দির খোলা হয়। ভোগের পর বন্ধ হয় ১টায়, আবার বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। সিউড়ির সোনাতোড় পাড়ার কাছেই রয়েছে মন্দির।
মন্দিরগাত্রের লেখা অনুযায়ী, বিষ্ণুপুরের স্বাধীন নরপতি বীর হাম্বিরের উত্তরসূরি ছিলেন চৈতন্য সিংহ। চৈতন্য সিংহের দেওয়ান ছিলেন তন্ত্রসাধক চণ্ডীচরণ মুখোপাধ্যায়। পলাশীর যুদ্ধের পর
বাংলার শাসন ক্ষমতা ইংরেজের হাতে গেলে, ইংরেজদের হাতে বন্দী হন দেওয়ান সাহেব। বন্দী হলেও, তন্ত্রসাধনা থামেনি। শোনা যায়, অলৌকিক ক্ষমতার বলে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। চণ্ডীচরণ মুখোপাধ্যায়ের পরিবার ছিল আদ্যন্ত শাক্ত। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর ছেলে কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও তন্ত্রসাধনা করতেন। কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাঁকুড়া থেকে বীরভূমের সিউড়িতে চলে আসেন। শ্মশানে তপস্যা করতেন তিনি। পরে কাশীধামে চলে যান কালীপ্রসাদ।
সিউড়ির যে'স্থানে কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সাধনা করতেন, সেই স্থানে মন্দির নির্মান করেন কালীকাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র কুলদানন্দ। কালীপ্রসাদের জীবৎকাল ১৭৯১-১৮৫৪ সাল। কালীপ্রসাদ জীবনের শেষ পাঁচ বছর কাশীবাসী হয়েছিলেন। ১৮৪৯ সালে তিনি নৌকাযোগে কাশী যাত্রা করেন। ১৮৫৪ নাগাদ পবিত্র কাশীধামেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে। তিনি আর সিউড়ি ফেরেননি।
কালীপ্রসাদ তন্ত্রসাধক ছিলেন। পৈতৃক গ্রাম ময়নাপুরে ১৮১৫ সালে তিনি বাৎসরিক শ্রীশ্রী শ্যামাপূজার প্রবর্তন করেন। সেখানে তিনি কালীমন্দিরও নির্মাণ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কালী পুজো আজও ময়নাপুরে হয়। সিউড়িতে থাকাকালীন তিনি শিবমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। ভবতারিণী কালী মন্দির সিউড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালীপ্রসাদের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র কুলদানন্দ।
আজও মুখোপাধ্যায় পরিবার মন্দিরের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মূর্তি তৈরি করেছিলেন দাঁইহাটের নবীন ভাস্কর। সিউড়ির বড় কালীবাড়ির মায়ের মূর্তিও তাঁরই হাতে গড়া। মুখোপাধ্যায় বাড়ির পারিবারিক পুজো এখন শহরবাসীর পুজোয় পরিণত হয়েছে। নিত্যদিন মায়ের পুজো হয়। দীপাণ্বিতা অমাবস্যার রাতে মহাধুমধাম করে পুজো হয়। প্রতিদিনই মায়ের পুজো ও সেবাভোগ হয়। গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে ভোগ দেওয়া হয় মায়ের। বারো মাসে বারোটি অমাবস্যাতে দেবীর পুজো ও ভোগ হয় ষোড়শোপচারে। এখানে কোনও পশু বলি হয় না। নিরামিষ ভোগ মাকে নিবেদন করা হয়।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, কুলদানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাবাকে মা স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন, সেই স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পরই শুরু হয় পুজো। তিনি জীবৎকলে মন্দির দেখে যেতে পারেননি, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই পুত্র কুলদানন্দ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। একদিকে রয়েছে পুকুর, শিবমন্দির অন্যদিকে আটচালা ও বড়কালী মায়ের মন্দির। সিউড়ির কালী বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোও হয়। অষ্টমী তিথিতে কুমারী পুজো হয়। মন্দির প্রাঙ্গণেই রয়েছে সুদৃশ্য নাটমন্দির। কুলদেশ্বর ও গোবিন্দেশ্বর নামে দুটি প্রাচীন শিবমন্দির রয়েছে। কুলদানন্দের পিতা সাধক কালীপ্রসাদের নামে একটি স্মৃতি উদ্যান আছে। মূল মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরিভাগে দু'দিকে দশমহাবিদ্যার মূর্তি রয়েছে। সাধক বামাক্ষ্যাপা, ঠাকুর সত্যানন্দদেব, ঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ প্রমুখ সিদ্ধ সাধকদের পদচিহ্ন পড়েছিল সিউড়ির এই কালী বাড়িতে।