দুগ্গা কথা: সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার দুর্গাপুজো

কলকাতা তথা বাংলার অন্যতম বিখ্যাত বনেদি পরিবার হল সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার। ১৬১০ সাল থেকে বড়িশার বাড়িতে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। বাংলার প্রাচীনতম দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে সাবর্ণ পরিবারে মোট আটটি দুর্গাপুজো হয়। এগুলির মধ্যে ছয়টি হয় বড়িশায় এবং সপ্তমটি হয় বিরাটিতে। বড়িশার পুজোগুলি হল আটচালা, বড়োবাড়ি, মেজোবাড়ি, বেনাকি বাড়ি, কালীকিংকর ভবন ও মাঝের বাড়ি। এই পরিবারের অন্যতম বিখ্যাত পুরুষ লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের আমল থেকে এই পরিবার সাবর্ণগোত্রীয় রায় চৌধুরী পরিবার নামে পরিচিতি পায়। জমিদার লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার, স্ত্রী ভগবতী দেবীর ইচ্ছায় ১৬১০ সালে এই পুজোর সূচনা করেন। ঋষি সাবর্ণির নামানুসারে সাবর্ণ গোত্র বা গোষ্ঠীর পরিচয়। তৎকালীন কাণ্যকুব্জ, অধুনা যা উত্তরপ্রদেশের কনৌজ নামে খ্যাত, সেখানেই ছিল তাদের বসবাস। সেকালের বাংলার ব্রাহ্মণেরা যজ্ঞকার্যে পারদর্শী না হওয়ায় রাজা আদিশূর যে পাঁচ ব্রাহ্মণকে কাণ্যকুব্জ থেকে এনেছিলেন, তাঁরাই রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত। সেই ব্রাহ্মণেরা হলেন- শ্রী বেদগর্ভ, শ্রী দক্ষ, শ্রী ভট্টনারায়ণ, শ্রী হর্ষ ও শ্রী ছন্দ। তারমধ্যে ঋষি সাবর্ণির পুত্র ঋষি সৌভরি ছিলেন একজন বাকসিদ্ধ বেদজ্ঞ সাগ্নিক ব্রাহ্মণ। মহারাজা আদিশূরের প্রার্থনা শুনে মহারাজ চন্দ্রকেতু গৌরবঙ্গে পাঁচজন বেদজ্ঞ সাগ্নিক ব্রাহ্মণ পাঠিয়েছিলেন। এভাবেই তারা বঙ্গদেশে এসে পড়েছিলেন।

Shaborno-ray-Choudhuri-lowres-1

১৬০৮ সালে সাবর্ণ গোত্রীয় শ্রী লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় জাহাঙ্গীরের থেকে উত্তরে হালিশহর থেকে দক্ষিণে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত ৮টি পরগণার নিষ্কর জমিদারি লাভ করেছিলেন। রায় ও চৌধুরী উপাধিও পেয়েছিলেন। ১৬১০ সালে শ্রী লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী ভগবতীদেবী বড়িশার আটচালায় কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন। সাবর্ণ পরিবারের দ্বাবিংশতিতম পুরুষ ও প্রথম জমিদার রায় লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার চৌধুরী প্রবর্তিত আটচালার দুর্গোৎসব বঙ্গদেশে সপরিবারে শ্রীদুর্গার প্রতিমা-পুজোর প্রাচীনতম নিদর্শন। যা আজ চার শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। বড়ো বাড়ি ও কালীকিঙ্কর ভবনের দুর্গাপুজোও শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় চেয়েও বয়সে প্রাচীন।

সাবর্ণ পরিবারের ২৭তম পুরুষ নন্দদুলাল রায় চৌধুরীর বড় ছেলে রাঘবেন্দ্র পাকাপাকি ভাবে বড়িশায় বসবাস করলেন। রাঘবেন্দ্রই প্রথম বড়িশাধিপতি খেতাব ব্যবহার শুরু করেন। এখন বড়িশা এলাকা দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা কলকাতার অন্তর্গত। কিন্তু প্রাচীন কালে এই বড়িশা গ্রাম খাসপুর পরগনার অন্তর্গত বহুলাপুরী বা বহুগ্রামের অংশ ছিল। রাঘবেন্দ্রের একমাত্র সন্তান হলেন তারিণীচরণ। এই পিতা-পুত্রের সময় বড়ো বাড়ির দুর্গোৎসব ও রথযাত্রা আরও খ্যাতি অর্জন করেছিল। তারিণীচরণ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বড়ো বাড়ির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে এক বাজার বসান। আগে ছিল সাপ্তাহিক হাট। প্রজাদের প্রয়োজনে ও এলাকার ব্যবসাকে সমৃদ্ধিশালী করার জন্য তা হল নিয়মিত বাজার। জমিদারের খেয়ালে বাজার, তাই নাম হয় সখের বাজার। তারিণীচরণের মোট আট ছেলে ছিল। কিন্তু তাঁদের মধ্যে শুধু রামকুমার, কালীকান্ত ও চন্দ্রকান্তের বংশ রক্ষা পেয়েছিল।

20180901_165603-e1536087741243

সাবর্ণ রায়চৌধুরীদেরই বংশধর ছিলেন রামকালী চৌধুরী। জমিদারি সামলাতে ১৭১১ সালে তিনি গিয়েছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার জগন্নাথপুর গ্রামে। সেখানে গিয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই পুজো শুরু করেন। পুজো ঘিরে রয়েছে স্বপ্নাদেশের গল্প। তিনশো বছরের বেশি সময় ধরে চন্দ্রকোণার জগন্নাথপুরের চৌধুরী পরিবারে পুজোর ঐতিহ্য অক্ষত। চন্দ্রকোণা এক নম্বর ব্লকের জগন্নাথপুরে একই জায়গায় প্রাচীন চারটি মন্দির। এক মন্দিরে শীতলা। আরেক মন্দিরে মহাদেব। রঘুনাথ বিষ্ণু মন্দিরের পাশেই দেবী দুর্গার মন্দির। এখন মন্দিরের জায়গায় তৈরি হয়েছে পাকা দালান। দুর্গার সঙ্গে পূজিত হন মহাদেবও। সন্ধিপুজোয় কালো পাঁঠা বলি দেওয়ার রীতি রয়েছে। প্রাচীন যুগ থেকে একই কাঠামোয় দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিকের পুজো হয়।
১৬১০ সালে লক্ষ্মীকান্ত যে চালু করেন সেটিই ছিল বাংলার প্রথম সপরিবারে দুর্গা আরাধনা। লক্ষ্মী,সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ এবং মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গাকে তিনি একই কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকে আজও চলছে। এবার তাদের ৪১২তম দুর্গোৎসব। নবমাদীকল্পে পুজোর বোধন শুরু হয় কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে অর্থাৎ মহানবমীর ১৫ দিন আগে।

সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের পুজো মোট ৮টি বাড়িতে হয়। প্রতিমার মুখ লাল বা হালকা সোনালী রঙের হয়ে থাকে। অসুরের গাত্রবর্ণ সবুজ। দেবীর চামুন্ডা মূর্তির রূপ ও রঙ আজও পরিবর্তন করা হয়নি। প্রাচীন রীতি অনুসারে দেবীর মুখমণ্ডল পানপাতার মত। টানা ত্রিনয়ন, গায়ের রঙ অতসী ফুলের মতো বা শিউলির বোটার রঙের। গণেশের রঙ লাল, রাজপুত্র বেশে কার্তিক। বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী রীতি মেনে ৮টি পুজো করা হয়। এই ৮টি পুজোর মধ্যে ৬টি পুজো হয় বড়িশাতে। সেই পুজো গুলি হল যথাক্রমে আটচালা বাড়ি পুজো, দ্বিতীয়টি বড় বাড়ির পুজো, তৃতীয়টি বেনাকি বাড়ি পুজো, চতুর্থটি মেজো বাড়ি পুজো, পঞ্চমটি কালীকিঙ্কর ভবন পুজো, ষষ্টটি মাঝের বাড়ি পুজো। সপ্তম পুজোটি হয় বিরাটিতে। বিরাটির পুজো বিরতি বাড়ির পুজো নামে পরিচিত। অষ্টম পুজটি হয় নিমতাতে, নিমতা পাঠানপুর বাড়ির পুজো।


সপ্তমী থেকে দশমী মা দুর্গাকে ১৮ টি ভাগে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। মুখে কাপড় বেঁধে রান্না করতে হয় ভোগ। পরিবারের সন্ধিপুজোর একটি বিশেষত্ব রয়েছে। সদ্যস্নাতা পরিবারের সদস্যা ভিজে গায়ে, ভিজ কাপড়ে ভোগ রান্না করেন। মায়ের ভোগে থাকে ল্যাটা বা শোল মাছ। অপদেবতাদের সন্তুষ্ট করতে অষ্টমী ও নবমীতে বিশেষ মাসভক্ত বলি পর্ব হয়, বড় বাড়িতে অর্ধরাত্রি পুজো আর বিরাটি বাড়িতে ধুনপোড়া দেওয়ার রেওয়াজ। পবিত্র সন্ধিপুজোক্ষণে নিমতা বাড়িতে হয় সাবর্ণ কুলদেবী মাতা ভুবনেশ্বরী দেবীর বিশেষ পুজো হয় এবং ক্ষীরের পুতুল বলি। সব পুজোর শুরুতেই কালীঘাটের মাকে স্মরণ করা হয়। এই পুজোর বিসর্জন প্রতিষ্ঠিত পুকুরে ঘট বিসর্জনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। দশমীর দিন ঘট বিসর্জনের পরেই প্রতিমার সামনেই করা হয় বিজয়া পর্ব, এরপরে বাবুঘাটে প্রতিমা বিসর্জণ করা হয়। পুজোর শেষে বাড়িতে তৈরি বোঁদে দিয়েই হয় দশমী পালন।

পুজো হয় এক চালচিত্রে। তবে একই চালচিত্রের মধ্যে থাকে তিন ভাগ। সাবর্ণ বাড়ির পুজোর চালচিত্রে থাকে ছিন্নমস্তা, বগলা, মাতঙ্গী, কমলাকামিনীসহ দশমহাবিদ্যা। দশমহাবিদ্যার সঙ্গে রয়েছেন রাধাকৃষ্ণ। দেবীর দুপাশে থাকেন শিব ও রাম। এই বাড়ির পুজোয় একদা ১৩টি ছাগল ও ১ টি মোষ বলি হত। সাবর্ণ রায় চৌধুরীর বাকি সমস্ত বাড়ি গুলিতে আমিষ ভোগের আয়োজন করা হয়। কেবলমাত্র নিমতার বাড়িতে হয় সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ।

দুর্গাপুজো শেষেই শুরু হয়ে যায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বিখ্যাত চন্ডীপুজো। মহেশচন্দ্র রায়চৌধুরীর আমল থেকেই এই পুজো হয়ে আসছে। কথিত রয়েছে, মা স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন। সেদিনই চন্ডীপুকুর থেকে একটি ঘট উঠেছিল। সেই ঘট আজও বড়িশার আদিচন্ডী বাড়িতে রাখা আছে, সেখানেই মা আদিচন্ডী পুজিত হন। এখানে পঞ্চমী-অষ্টমীতে মূল পুজো ও ভোগ হয়। কথিত আছে পঞ্চমীতে মা চন্ডীর জন্মদিন। অষ্টমী ও নবমীতে হয় মূল পুজো। পুজোর সাথেই মেলা বসে। মেলা ও পুজো চলে ১০ দিন ধরে।

বাড়ি সংলগ্ন জমিতে আটচালার চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণ করে মাতৃ আরাধনা শুরু করেন লক্ষ্মীকান্ত। একদা গোলপাতার ছাউনি ছিল। পরে তা টালির চালে রূপান্তরিত হয়। মন্ডপের সামনের থামগুলি তার উপর আগে ছাদ ছিল কিন্তু কালের গহ্বরে তা মুছে গিয়েছে। থামগুলো আজও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চার শতকেরও অধিক সময় ধরে এই পরিবারের দুর্গা আরাধনা চলছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...