অ্যালেন পার্ক, পার্ক স্ট্রিটে শুরু হয়ে গিয়েছে কলকাতা ক্রিসমাস ফেস্টিভ্যাল। ২০১১ সাল থেকে কলকাতার বড়দিনের উৎসবকে 'কলকাতা ক্রিসমাস ফেস্টিভাল' নামে অভিহিত করা হয়েছে, জনসমাগমের দিক থেকে এটি সমগ্র পূর্ব ভারতে সবচেয়ে বড়দিনের উৎসব।
সমানেই বড়দিন, তারপর নতুন বছর, লম্বা উৎসবের মরশুম। বড়দিন এখন বাংলার লৌকিক উৎসব, বড়দিন সকলের। রানাঘাট, কৃষ্ণনগর থেকে শুরু করে দার্জিলিং, কোচবিহার সর্বত্র এ উৎসবের মেজাজটাই আলাদা। আর খাস কলকাতার বড়দিন, কলোনিয়াল আমল থেকে শুরু হয়ে, আজ সে কলকাতার ঘরের উৎসব। রিপন স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, নিউমার্কেট, ডালহৌসি, চৌরঙ্গী, বো'ব্যারাকসের সঙ্গে সাবেক শহরটাও যেন সাহেবিয়ানায় সেজে ওঠে
আলোর রোশনাই আর উৎসবের আমেজ আজ আমার আপনার শহরে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন কি না, এ নিয়ে বিতর্ক আছে।
কিন্তু আজ সকল ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ মেতে ওঠে বড়দিন পালনে, সবার প্রিয় উৎসবের দিন বড়দিন। ২৫ তারিখ থেকেই ১২ দিনব্যাপী ক্রিসমাসটাইড অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ হয়। উপহার বিতরণ, গ্রিটিংস কার্ড বিনিময়, ক্রিসমাস ক্যারলের সুর, গির্জায় গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা, যিশুর উপাসনা, ক্রিসমাস ট্রি দিয়ে বাড়ি সাজানো, নানা উপকরণে ঘর সাজানো, আলোকসজ্জা, হরেকরকম বাহারি ভোজের আয়োজন সব মিলিয়েই বড়দিন।
কিন্তু খাস কলকাতায় বড়দিন শুরু হল কবে থেকে?
বণিক জোব চার্ণক, মোঘলদের তাড়া খেয়ে হুগলি ছেড়ে পালাচ্ছেন। বালেশ্বর যাবেন। পথে আশ্রয় নিলেন সুতানুটিতে, সুতানুটি তখন জঙ্গল ঘেরা এক হাট। এই ভাবেই গা ঢাকা দিয়ে দু-মাস কেটে গেল আর দেখতে দেখতে ক্রিসমাস চলে এল, সালটা ১৬৬৮ কলকাতায় প্রথমবারের জন্যে ক্রিসমাস উদযাপন হল। তখনও আজকের কলকাতা গড়ে ওঠেনি।
তবে এর এক শতাব্দী পরে শহরে শুরু হল জাঁকিয়ে ক্রিসমাস পালন।
পলাশি ও বক্সার যুদ্ধ জিতে ব্রিটিশ ভারতে, তাদের পুরোদস্তুর শাসন কায়েম করেছিল। তারপর থেকেই কলকাতার বুকে ক্রিসমাস পালনের সূচনা। কলকাতা তখন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের রাজধানী, বড়দিন এলেই এ দেশের সাহেব মেমদের স্বদেশের কথা মনে পড়ত। বড়দিনের আগেই সাহেবরা বাড়িঘর ঠিকঠাক করতে শুরু করতেন ও চুনকাম করাতেন। ঘর গোছাতে শুরু করত। কলকাতার প্রথম আর্চবিশপ রেজিনাল্ড হেবার ১৮২৩-এ তাঁর জার্নালে উল্লেখ করেছিলেন, সেই সময় ডালহৌসি এবং চৌরঙ্গী অঞ্চলের প্রত্যেক সাহেব-বাড়িই দেবদারু গাছের ডাল, ফুল, লতাপাতা দিয়ে সাজানো হত।
আজ শহরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অজস্র চার্চ। আজও সেগুলোতে উপাসনা হয়। ক্রিসমাস উৎসব চলে। সেকালের কলকাতার চার্চের সংখ্যা কম ছিল না! ইউরোপীয়দের বিভিন্ন জাতির চার্চের মিলন ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছিল কলকাতা।
উনিশ শতকের গোড়ায় কলকাতায় ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা যথেষ্ট বেড়ে গিয়েছিল। ১৭৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সেন্ট জনস চার্চে তাদের উপাসনার স্থান সঙ্কুলান হচ্ছিল না। ফলে কলকাতার পঞ্চম বিশপ, ড্যানিয়েল উইলসনের উদ্যোগে ১৮৩৯ সালে তৈরি হল সেন্ট ক্যাথিড্রাল চার্চ, যাতে ৮০০-১০০০ মানুষ একত্রে উপাসনা করতে পারে। ব্রিটিশ ভারতের এই ঐতিহ্যমণ্ডিত চার্চে ক্রিসমাস মিডনাইট মাসে অংশ নিয়ে ক্যারলে এখনও গলা মেলান হাজার হাজার মানুষ।
রবীন্দ্র সদন ও ময়দান মেট্রো স্টেশনের মাঝে অবস্থিত সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল চার্চ। কলকাতার সবচেয়ে আইকনিক গির্জাগুলির মধ্যে একটি হল সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল। ইন্দো-গথিক স্থাপত্যের একটি দুর্দান্ত নিদর্শন এই চার্চ। ১৮৪৭ সালে এটি তৈরি হয়। এশিয়ার প্রথম 'এপিস্কোপাল চার্চ' হিসেবে বিবেচিত হয়। সেন্ট অ্যান্ড্রু'স চার্চকে শহরের প্রথম এবং একমাত্র স্কটিশ চার্চ হিসাবে গণ্য করা হয়। ১৮১৮ সালে এই গির্জাটি নির্মাণ করা হয়।
আজও বড়দিনে সেজে ওঠে এই চার্চগুলো।যদিও কলকাতায় ইংরেজ বনিকদের আগে আর্মেনিয়ানদের পা পড়েছিল। এরাও কলকাতায় চার্চ বানিয়েছিল, কলকাতার আর্মেনিয়ান চার্চটি ১৭২৪ সালে নির্মিত হয়েছিল, যা এই শহরের প্রাচীনতম চার্চগুলির মধ্যে একটি। ১৬৮৮ সালে আর্মেনিয়ান চার্চটি আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরে বর্তমানের চার্চটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। আজও কলকাতার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার আর্মেনিয়ান চার্চ।
বড়দিনের আরেকটি অপরিহার্য অঙ্গ ক্রিসমাস ক্যারল, যা এখন গির্জায় গির্জায় প্রার্থনায় গাওয়া হয়। ক্যারল হল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকসঙ্গীত। প্রাচীনতম ক্রিসমাস ক্যারল রচিত হয়েছিল রোমে, খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে। ত্রয়োদশ শতকে ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইটালিতে আঞ্চলিক ভাষায় জনপ্রিয় ক্রিসমাস সঙ্গীতের প্রথা গড়ে ওঠে। গির্জায় ক্যারল গাওয়ার সূচনা হয়। আজও, সারা বিশ্বের মানুষের দরজায় দরজায় শীত ও বড়দিন সম্বন্ধীয় আনন্দের স্তবগান ও ক্যারোল গেয়ে বেড়ানো হয়, ক্যারোল গান ছাড়া ক্রিসমাস অসম্পূর্ণ। বড়দিনের উৎসবে আলাদা অনুভূতি এনে দেয় এই ক্যারোল গান। বড়দিনের উৎসবে যোগ দিয়ে ক্যারোল গানে মেতে ওঠেন সবাই। এই ক্যারোল গান কলকাতার বড়দিনকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
আরও দুটি জিনিস ছাড়া ক্রিসমাস এক্কেবারেই অসম্পূর্ণ, ক্রিসমাস ট্রি আর স্যান্টা ক্লজ। আমাদের কাছে স্যান্টা, সাদা ঝোলাওয়ালা বুড়ো দাদু। লাল পোশাকে ঢাকা সাদা দাড়ির ঐ দাদুই আমাদের ইচ্ছেপূরণের কারিগর। শোনা যায়, চতুর্থ শতাব্দীতে এশিয়া মাইনরের মায়েরাতে সেন্ট নিকোলাস নামে এক দয়ালু ব্যক্তি থাকতেন। নিকোলাস দুঃখকষ্টে থাকা লোকেদের সাহায্য করতেন। এক বার তিনি শুনলেন, এক গরিব লোকের তিন মেয়ে, কিন্তু তার মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পয়সা নেই। নিকোলাস লুকিয়ে বাড়ির চিমনির কাছে পৌঁছে চিমনির মধ্যে দিয়ে সোনাদানা ফেলে দিলেন।
লোকটি চিমনিতে তার মোজা শুকোতে দিয়েছিল। সকালে উঠে দেখে সোনাদানায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে ঐ মোজা! এখনও ক্রিসমাস ইভে মোজা রেখে দেওয়ার নিয়ম। এমন পর পর তিন বার হওয়ায় তার সন্দেহ হয়। সে চিমনির পাশে লুকিয়ে থেকে নিকোলাসকে ধরে ফেলে। কিন্তু সহৃদয় নিকোলাস তার এই পরোপকারের কথা জানাজানি করতে চাননি। তবুও লোকে জেনেই গেল, আর তার পর থেকে কেউ গোপনে উপহার পেলেই লোকে মনে করে, নিকোলাস দিয়েছে। এই সেন্ট নিকোলাসের গল্পই বণিকদের মাধ্যমে পৃথিবীর নানা জায়গায় পাড়ি দিয়ে স্যান্টা ক্লজ হয়েছেন সম্ভবত।
শীতের পাতা ঝরার দিনে রোমে চিরহরিৎ বৃক্ষের ডাল দিয়ে ঘর সাজানোর প্রথা ছিল। আইভি লতার পানপাতার মতো হৃদয় আকৃতির পাতা ও লাল বেরি দিয়ে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়। ওই সবুজ পাতা জিশুর পুনরুত্থানের প্রতীক আর বেরিগুলো ক্রুশবিদ্ধ যিশুর রক্তবিন্দুর প্রতীক। এখন আমরা বল, স্টার, আলো দিয়ে ক্রিসমাস ট্রি সাজাই।
কলকাতায় ব্রাহ্মধর্মে উপনিষদীয় অদ্বৈতবাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল খ্রিস্টধর্মের একেশ্বরবাদ। ব্রহ্মসঙ্গীত এবং অন্যান্য উপাসনা পদ্ধতিতেও খ্রিস্টপ্রভাব দেখা যায়। কবিগুরুর কাছে যিশু ছিলেন কল্যাণের দূত। খ্রিস্ট ধর্মযাজক অধ্যাপক ফাদার ডি পেনেরান্ডার প্রভাব কবির জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল।
পরবর্তী কালে তিনি যিশুর জন্মোৎসব পালনকে শান্তিনিকেতনের পৌষ উৎসবের অঙ্গীভূত করেন। তিন দিনের আনন্দময় পৌষ-উৎসবের সমাপ্তি দিবস কিন্তু বড়দিনের দিন, খ্রিস্ট-উৎসব। এই উপাসনায় মহামানব যিশুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সকলে সমবেত হন। মোমের আলোয় মুখরিত হয়ে ওঠে 'ক্রিসমাস ক্যারল', গাওয়া হয় কবির লেখা 'একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে, রাজার দোহাই দিয়ে', উচ্চারিত হয় উপনিষদের মন্ত্র, কবির লেখা এবং বাইবেলের অংশবিশেষ থেকে পাঠ করা হয়।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও খ্রিস্ট ধর্মের আরাধনা করেছিলেন। ১৮৭৩ সালের শেষ ভাগে শম্ভুচরণ মল্লিকের মুখে বাইবেল পাঠ শুনে, খ্রিস্টমতে সাধনা করে সত্য উপলব্ধির ইচ্ছে হয় পরমহংসদেবের। খ্রিস্ট ধর্মের আরাধনাও করেছিলেন ঠাকুর। ঐ সময় তিনি কালীঘরে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন। এক দিন যিশুর দিব্যদর্শনও লাভ করেছিলেন তিনি। তাঁর ঘরে হিন্দু দেবদেবীদের সঙ্গে জলমগ্ন যিশুর একটি ছবি ছিল, সেটিতে তিনি প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় ধূপারতি করতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের পার্শ্বজ শিষ্যদের একটি দল হুগলির আঁটপুরে বাবুরাম মহারাজ অর্থাৎ স্বামী প্রেমানন্দের পৈতৃক বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। এক দিন সন্ধ্যার পর বিবেকানন্দ যিশুর পবিত্র চরিত্রের আলোচনা করতে করতে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করছিলেন। ওই দিন ধুনি জ্বেলে তাঁরা পবিত্র অগ্নির সামনে সেই দ্বাদশ শিষ্যের মতো সংসার ত্যাগ করে পরহিতে জীবন উৎসর্গের শপথ গ্রহণ করেন। দিনটি ছিল বড়দিনের আগের দিন। ২৪ ডিসেম্বর রাতে আঁটপুরে ভাবী রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের বীজ বপন করা হয়েছিল।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের কেন্দ্রগুলিতে আজও বড়দিনে যিশুর জন্মোৎসব পালিত হয়। ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যারতির পর শুরু হয় যিশুর আরাধনা। শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরে যিশুর ও মেরিমাতার ছবি মোমবাতি, ফুল দিয়ে সাজানো হয়। কেক, লজেন্স, ফল, পেস্ট্রি ও মিষ্টি দেওয়া হয়। ক্যারলের মাধ্যমে পুজোর সূচনা হয়। ২৫ ডিসেম্বর ইংরেজি ও বাংলায় বাইবেল ও যিশুর জন্মকাহিনি পাঠ করা হয়। উপস্থিত থাকেন বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীরা ও ভক্তগণ। এইভাবে কোথায় যেন যিশু আমাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন সকলের আরাধ্য। যে ঐভাবে দু-হাত বাড়িয়ে পবিত্র আহ্বান করছেন, তাকে উপেক্ষা কী করা যায়। কলকাতা শহরের তিনশো বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বড়দিনের উৎসব।