কত কালের কত ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের পুরনো শহর- কলকাতা। আজকের কলকাতার এত রঙচঙে আলোর রোশনাই সেই পুরনো শহরটায় ছিল না। আসলে শহরটা তখন শহরই ছিল না, ছিল গ্রাম। এককালে কেরসিন-হ্যাচ্যাক-প্রদীপের আলোয় দেখতে হত এই শহরকে থুড়ি গ্রাম টিকে। তারপর তাঁরা এলেন। ‘তাঁরা’ মানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাঁদের জন্যই গ্রামটি ক্রমশ শহুরে হয়ে উঠতে শুরু করে। কলকাতা পত্তনের ইতিহাস বলে, জব চার্নক, যাঁকে আমরা ‘কলকাতার জনক’ বলেই জানি, ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির(ইস্ট ইন্ডিয়া) জন্য কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম মুঘল সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সুতানুটি ছিল তখন ওই অঞ্চলে সুতো আর বোনা কাপড়ের একটি প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। বর্তমান উত্তর কলকাতার বাগবাজার, শ্যামবাজার, ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিই অতীতে সুতানুটি গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। জব চার্নক এই সুতানুটি গ্রামেই আমৃত্যু ছিলেন। তাঁর হাত ধরে নগর পত্তন তো হল, তারপর?
তারপর এল ফোর্ট উইলিয়ম, ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ম নামানুসারে এই দুর্গের চারদিকে ইউরোপীয়ানদের ব্যক্তিগত বসতবাড়ি গড়ে ওঠা শুরু হয়। কোম্পানি কিছু কিছু স্থানীয় অধিবাসীদের জমিদারি দেওয়ায় কর্মসংস্থানের রাস্তাও খুলে যায়, সদ্য গড়ে ওঠা এই নগর তিনটিতে ভিড় জমাতে শুরু করেন বহু মানুষ, স্বল্পবসতিপূর্ণ জায়গাটি ক্রমেই ঘন বসতিতে পরিণত হয়। নগরায়নের প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে বিকাশ পায়। বর্গি(মারাঠা) হামলায় হুগলী নদীর পশ্চিম তীর থেকে বহু লোক একযোগে গ্রাম ছাড়লে শহরের লোকসংখ্যা আরও বেড়ে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে কলকাতা শহরের কলেবর ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে।
প্রান্তীয় জনগণ যেমন রাস্তার ঝাড়ুদার (হাড়ি ও ধাঙর), বিহারি দুধওয়ালা (আহির), বাঙালি দুধওয়ালা (গোয়ালা), লেপ-তোশক সেলাইকারী (কম্বুলিয়া), কসাই, ভেষজ গুণসম্পন্ন লতাপাতা সংগ্রাহক ও বিক্রেতা (কাওড়া), তাল-মিছরি উৎপাদনকারী (গুড়ি), কাঠমিস্ত্রি (ছুতার), মৎস্যজীবী (জেলে), মুসলিম বয়নকারী (জোলা), কয়লার সূক্ষ্ম চূর্ণ দিয়ে টিকিয়া তৈরীর কাজে লিপ্ত মুসলমান, মৃতদেহ দাহকারী (ডোম), ঢোলবাদক (ঢুলি), পুস্তক বাঁধাইকারী (দপ্তরি), ধোপা, মাছ কাটার সাথে জড়িত মুসলমান (নিকারি), চিত্রকর (পটুয়া), তরি-তরকারি ও শাক-সবজি বিক্রেতা (ফড়িয়া), গরুর গাড়ি চালক (বলদিয়া), যাযাবর (বেদিয়া), ভোজবাজিকর (ভালুকওয়ালা ও ডুগডুগিওয়ালা), নৌকা চালক (মাল্লা), মুচি, শাঁখারি, শিকারি সকলেই কলকাতার বিভিন্ন স্থানের নামকরণে স্বীকৃতি পায়। বারবনিতারাও স্বতন্ত্র একটি দল গঠন করে। ইউরোপীয় ও স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সমস্ত নগরীব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত।
দলে দলে ভিড় জমাতে থাকা বিপুল জনসংখ্যার জন্য কলকাতায় পূর্ণাঙ্গ পৌর প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। ১৭২৭ সালের রাজকীয় সনদের অধীনে প্রতিষ্ঠিত একজন মেয়র ও নয়জন বিশেষ সম্মানিত সদস্য নিয়ে গঠিত মেয়রের আদালত ব্রিটিশবাসীদের জন্য দেওয়ানি, ফৌজদারি ও গির্জা সংক্রান্ত বিচারকাজ পরিচালনা ও কর আদায়ের কাজ করত। এই বিরাজমান ব্যবস্থা সংশোধনের জন্য ১৭৯৪ সালে বিচারকদের নিয়োগ করা হয়। কিন্তু সম্পদের ঘাটতি তাঁদেরকে অসহায় করে তোলে এবং ১৮০৩ সালে ওয়েলেসলী সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হন।
পরবর্তী সময়ের উন্নতিবিধান ও লটারি কমিটিদ্বয়ের সফল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নগরীটির শোচনীয় স্বাস্থ্যগত অবস্থা দেখে লর্ড অকল্যান্ড ১৮৩৬ সালে ফিভার হসপিটাল ও পৌর উন্নতির জন্য কমিটি তৈরীর উদ্যোগ নেন। অনেক চেষ্টার পর সেই কমিটি আমূল সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেয়। এই পরিবর্তনসমূহকে বাস্তবায়িত করতে নির্বাচিত ও মনোনীতি উভয় পদ্ধতিতে কমিশনারদের নিয়োগ করার জন্য নতুন আইন প্রণীত হয়, শুধু তাই নয় অর্থনীতি, রাস্তাঘাট, পয়ঃনিষ্কাশন ও জল সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ১৮৭৭ সালে একটি পরিষদ গঠন করা হয়। এভাবে বিভিন্ন আইন প্রণনয় হতে হতেই পরিষদের নজরে আসে ‘বিদ্যুৎ-এর প্রয়োজনীয়তা’র ব্যপার টি।
১৮৯৫ সালে বৈদ্যুতিক বাতি আইন প্রণয়ন ও কলকাতা বৈদ্যুতিক বাতি লাইসেন্স প্রবর্তনের (১৮৯৬) পরে ভারতীয় বিদ্যুৎ কোং লি. প্রথম লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয় (ডিসেম্বর, ১৮৯৬)। কোম্পানিটি শীঘ্রই তার নাম পরিবর্তন করে ‘কলকাতা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্পোরেশন লি.’ করে ফেলে (ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৭) এবং অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে‘ক্রোম্পটন’ ডায়নামো, ‘উইলান্স’ ইঞ্জিন ও ‘বেকক অ্যান্ড উইলকক্স’ বয়লারের সাহায্যে ইমামবাগ লেনে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্টেশন তৈরী করা হয়। ১৮৯৯ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ‘ক্যালকাটা’য় বিদ্যুৎ সরবরাহ আরম্ভ হয়।