কালী কথা: ক্ষীরপাইয়ের বড়মা, শান্তিদায়িনী কালিকা

আজকের কালী কথায় পশ্চিম মেদিনীপুরের এক কালীর কথা, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ক্ষীরপাই বাবরশার জন্য বিখ্যাত। এখানেই রয়েছে বড়মার মন্দির। হ্যাঁ, মা কালীর আকার অতিকায় হওয়ার কারণেই তাঁকে বড়মা বলে ডাকেন সব্বাই। ক্ষীরপাইয়ের প্রাণকেন্দ্র হল হালদারদিঘি মোড়। তার এক কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থিত বড়মার মন্দির। কেবল চন্দ্রকোনা বা ক্ষীরপাই নয়, গোটা মেদিনীপুরের কাছে এই মন্দিরের দেবী কালিকা 'বড়মা' নামেই খ্যার। মন্দিরের বয়স খুব জোর কুড়ি একুশ বছর। সব্বাই বড়মাকে খুব জাগ্রত বলেই মনে করে।

চিরকুনডাঙ্গা এলাকার কংক্রীটের তৈরি ৪৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বিশালাকার কালী প্রতিমাই ভক্তদের 'বড়মা'। ভিন জেলাও আজ এই কালী মাকে বড়মা নামেই জানে। ক্ষীরপাইয়ের বড়মার পুজোর অপেক্ষায় থাকে অসংখ্য মানুষ। পুজোর সময় আশপাশের মানুষ ছাড়াও গোটা পশ্চিম মেদিনীপুর ও ভিন জেলার দূরদূরান্তের মানুষ ভিড় জমায় ক্ষীরপাইয়ের বড়মার পুজোয়। এই মন্দিরের বড়মা আদপে শ্মশানকালী। তবে এই পুজোয় বলি হয় না। যাবতীয় রীতি মেনে পুজো হয়।

IMG-20231221-WA0007

শোনা যায়, আজ থেকে বছর কুড়ি আগে জনৈক শুদ্ধদেব রায় শশ্মানের উপর বড়মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। একেবারে প্রথমে মাটির চালায় প্রতিমা তৈরি করে পুজোর শুরু করেন, সেই প্রতিমা ছোটমা নামেই পরিচিত। ক্ষীরপাই বন্যা পীড়িত হওয়ায়, একদা বন্যায় ছোট মায়ের মাটির চালা ডুবে গিয়ে মুর্তি ভেঙে যায়। তবে মায়ের একটি ভাঙা হাত থেকে গিয়েছিল, আজও তা ছোট মায়ের নয়া মুর্তির পাশে রাখা রয়েছে। পরে ছোট মায়ের পাশেই ৪৫ ফুট উচ্চতার কংক্রীটের মায়ের মুর্তি নির্মান করে মন্দির তৈরি হয়। অনেকেরই মত, গোটা বাংলায় এতো বড় মাপের কালী প্রতিমা আর নেই।

অমবস্যা তিথি ছাড়া বড়মায়ের মন্দিরে অন্য কোনও দিন কোনও পুরোহিত থাকে না। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ মায়ের দর্শনে আসেন। তারা নিজেরাই নিজের মতো করে মায়ের পুজো দেন, পুরোহিত ছাড়াই চলে সবটা। ভক্তদের হাতেই মন্দিরের পুজো আর্চনার দায়িত্ব থাকে। যে'যার নিজের মতো করে নিজে হাতে বড়মার পুজো দেয়। এ মন্দিরে দক্ষিণার কোনও ব্যাপার নেই। আগত ভক্তদের নিষেধ রয়েছে দক্ষিনা দেওয়ার ক্ষেত্রে, কোনও প্রণামী বাক্স নেই মন্দিরে। প্রতি অমাবস্যায় পুজো হয়। ভক্তের দাবি মায়ের কাছে কিছু চাইলে তা পুরন হবেই। রোগের নিরাময়ের জন্যও কেউ কেউ মায়ের শরণাপন্ন হন, লোকের বিশ্বাস দেবীর কৃপায় আরোগ্য লাভ হয়। অনেকের দাবী তাতে বিমুখ হয়নি কেউ।

মন্দিরে সাফ লেখা রয়েছে, অর্থের বিনিময়ে নয়। নিজে হাতে পুজো করুন মাকে। কংক্রীটের বড় মায়ের এক হাতে রয়েছে পৃথিবী আর অন্য হাতে সাদা পায়রা, বাকি দুই হাতে খড়্গ ও নরমুণ্ড। মায়ের রুদ্র রূপ। রক্ষাকর্তী ও শান্তির বাহক হিসেবে একহাতে পৃথিবী ও অপর হাতে পায়রা রয়েছে বলে দাবি ভক্তদের। কালী পুজোর দিন বড়মার মন্দিরে হাজারও ভক্তসমাগম হয়।

বড়মার পুজোয় বলি হয় না, কিন্তু মাটির চালায় ছোটমায়ের পুজোয় বলি হয়। বলির মাংস প্রসাদ হিসেবে পরদিন খিচুড়ি প্রসাদে মিশিয়ে ভক্তদের বিতরণ করা হয়। গ্রামের যত দূর দেখা যায়, কেবলই কৃষি জমি। একটি বড় মন্দির, যা আর পাঁচটা সাধারণ মন্দিরের থেকে মন্দির অনেকটাই আলাদা। ইটের দেওয়ালের উপরে টিনের চাল। পলেস্তরার আস্তরণ রয়েছে। অদূরেই রয়েছে কেঠা নদী।

মন্দিরের আশেপাশে কোনও পুজো সামগ্রির দোকান নেই, পুজোর ফল প্রসাদ, দক্ষিণা, কিছুই দেওয়া যায় না মন্দিরে। ইচ্ছা হলে মায়ের জন্য প্রসাদ রেখে, বাকিটা নিয়ে যেতে পারেন ভক্ত। জানা যায়, স্থানীয় ব্যবসায়ী গোপাল রায় ছিলেন মা কালীর ভক্ত, প্রায়ই তিনি দেবীর আরাধনায় মেতে উঠতেন। একসময় সমস্ত ব্যবসা ছেড়ে তন্ত্র সাধক হয়ে যান গোপালবাবু। স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই 'বড়মা' কালীর প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। মাটির তৈরি প্রতিমাতে পুজো করতেন। সাধক বাবার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেন পুত্ররা। ক্ষীরপাই শহরের গোকুলি মাঠের শ্মশানের পাশে নিজেদের জমিতে কালী মন্দির গড়ে তোলেন তান্ত্রিক গোপালচন্দ্র রায়ের সাত পুত্র। বিশালাকার এই ভয়ঙ্কর মূর্তি নির্মাণ করেছেন মৃৎশিল্পী রনজিৎ দাস। মা এখানে চতুর্ভুজা। মা শিবের বুকে এক পা আর অন্য পা মাটিতে রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। রূপ ভয়ঙ্কর, দন্তবিকশিত, উদগত চোখ, রক্তাক্ত ঠোঁট, কালাে গায়ের রঙ। দেবীর দু'পাশে থাকেন নখদন্তধারী নরমাংস ভক্ষণকারী ডাকিনী যোগিনী।

মন্দিরের প্রবেশদ্বারে থাকে বাক্স। সেখানে দশ টাকা দিয়ে ভক্তরা ধূপকাঠি নিতে পারেন। মন্দিরে দেবীর সামনে তা জ্বালান। মূল মন্দিরের জানালা ও বাইরের কাগজ ফুলের গাছের ডালে অজস্র ধূপের ওই প্যাকেট গুলো বাঁধা। ভক্তরা মায়ের কাছে মনস্কামনা জানিয়ে এগুলো বেঁধে যায়, প্রাপ্তিতে এসে খুলে  দিয়ে যায়। মায়ের মন্দিরে সবসময় পাওয়া যায় সাদা পায়রার দল। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় স্থানীয় মানুষ ছাড়াও জেলার বাইরের দূর-দুরান্তের মানুষও ভিড় জমায় ক্ষীরপাইয়ের বড়মার পুজোয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...