আজ কালী কথায় হাওড়ার বুড়িমার কথা। নৈহাটিতে আছেন বড়মা, কৃষ্ণনগরে রয়েছেন বুড়িমা। কৃষ্ণনগরের বুড়মা জগদ্ধাত্রী হলেও, হাওড়ার বুড়িমা হলেন কালী। হাওড়ার খলিশানির কালীতলায় কয়েক শতাব্দী জুড়ে পূজিত হচ্ছেন বুড়িমা। কেউ কেউ বলেন বুড়িমার বয়স তিনশো, আবার কারও মতে এই পুজোর বয়স চারশো বছরেরও বেশি। মায়ের মাহাত্ম্য যুগ যুগ ধরে প্রচার হয়ে চলেছে। দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা ছুটে আসেন মায়ের কাছে। এক যুগ পর পর বুড়িমার বিসর্জন হয় অর্থাৎ বারো বছর পর পর দেবীর নিরঞ্জন হয়।
প্রায় সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি প্রাচীন উলুবেড়িয়ার খলিশানির বুড়িমার পুজো আড়ম্বরহীন। নিত্যপুজো ও বলির রেওয়াজ রয়েছে এই মন্দিরে। একদা জঙ্গলে ঘেরা শ্মশান ছিল এই অঞ্চলে। তার মাঝেই গড়ে ওঠে কালী মন্দির। একসময় ডাকাতরা এই মন্দিরে বুড়িমার পুজো করত। শোনা যায়, আমতার বাসিন্দা কালিকুমার ভট্টাচার্য এই পুজো আরম্ভ করেন। তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান এবং পুজো শুরু করেন। স্বপ্নে কালিকুমার আদেশ পান, দেবীর কথা মতো উলুবেড়িয়ার খলিশানিতে একটি বেলগাছের তলায় মাটির ঘট পাওয়া যায়। তদানিন্তন সময়, গোটা এলাকা ছিল জঙ্গলে ঘেরা, শ্মশান। সেখানেই পুজো শুরু করেন কালিকুমার। সাড়ে তিনশো বছর ধরে দেবী এখানে ঘটে পুজিত হয়ে আসছেন। পরবর্তীতে দেবীর স্থায়ী মূর্তি গড়ে পুজো শুরু হয়। জানা যায়, প্রথমে আমতার হরিশদাদপুরে এই কালীমূর্তি স্থাপন করেছিলেন কালিকুমার ভট্টাচার্য। পরবর্তীতে তিনি খলিশানীতে চলে আসেন।
ভক্তদের বিশ্বাস, খলিশানি কালীমন্দিরে বুড়িমার কাছে পৌঁছতে পারলেই দূরারোগ্য ব্যাধি দূর হয়। মনস্কামনা পূর্ণ হয়। মন্দিরে ভক্তদের আনাগোনা লেগেই থাকে। মন্দিরের পিছনে একটি পুকুরে বুড়িমা স্নান ঘাটে বিগ্রহ নিরঞ্জন। পুরনো বিগ্রহ নিরঞ্জনের পর মূল মন্দির সংলগ্ন নাট মন্দিরে নতুন বিগ্রহ তৈরির কাজ শুরু হয়। মহালয়ার পরের দিন, মাতৃপক্ষের প্রতিপদে বিগ্রহ ফের স্থাপন করা হয়।
আরেক কিংবদন্তি অনুযায়ী, আমতার হরিশদাদপুরের একটি ভাঙা ঘরে অনাদরে পড়েছিলেন বুড়িমা। স্বপ্নাদেশ পেয়ে সেই মূর্তি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। খলিশানি কালীতলায় শ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গৌরী গঙ্গা নদীর পাশে এক জায়গায় একটি পূণ্য কলস পাওয়া গিয়েছিল। সেখানেই মাটির ছোট একটি ঘরে মূর্তি তৈরি করে পুজো শুরু হয়। পরবর্তী সময় আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্য।
শ্মশান থাকায় এলাকায় মানুষজনের খুব একটা বসবাস ছিল না। দিনের বেলাও গা ছমছমে পরিবেশ থাকত। দেবী জাগ্রত বলে, ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে বুড়িমার কাছে আশীর্বাদ নিত ডাকাতরা। প্রতিদিনের নিত্যপুজোর পাশাপাশি প্রতি অমাবস্যায় ও কালীপুজোর দিন বিশেষ পুজো হয়। সে সময় ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা বাড়ির যেকোনও শুভ অনুষ্ঠান বা শুভ কাজের আগে বুড়িমার কাছে শুরু দেন। পুজো দেওয়ার পর অনুষ্ঠান শুরু হয়। তেমনই রীতি।
বিপদগ্রস্ত, অসহায় মানুষরা ছুটে আসেন মায়ের কাছে। মানুষের বিশ্বাস, মা কাউকে ফেরান না। ১৬ নম্বর জাতীয় সড়কের খলিশানি কালীতলা স্টপেজ থেকে পশ্চিমদিকে কিছুটা এগোলেই চোখে পড়বে বুড়িমার মন্দির। এই ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কার্যত তিল ধারণের জায়গা থাকে না। খলিশানি ও তার পাশ্ববর্তী এলাকায় প্রায় শতাধিক কালীপুজো হয়। কিন্তু সকলেই আগে বুড়িমার কাছে পুজো নিবেদন করেন, তারপর অন্যত্র কালীপুজো হয়। খলিশানি এলাকার সমস্ত কালীপুজো কমিটি এই কালীবাড়িতে পুজো দেন। তারপর তাদের মন্ডপে পুজো শুরু হয়। তিন শতকেরও বেশি সময় ধরে পূজিত হচ্ছে দেবী কালিকা, রীতিনীতি, নিষ্ঠায় বিন্দুমাত্র বদল হয়নি। কার্তিক ও পৌষ মাসে দু'বার মহাসমারোহে মায়ের পুজো হয়। সারা বছরই ভক্তদের ভিড় লেগে থাকে।