কালী কথা: উত্তরেশ্বর কেঁউদি কালী

বঙ্গের দেবী কালী, বাংলার প্রতিটি প্রান্তে রয়েছে তাঁর মন্দির। এক একটি মন্দির ঘিরে রয়েছে ইতিহাস, অতিপ্রাকৃতিক কাহিনি। ঝাড়গ্রামের সেবায়তনে রয়েছে কেঁউদি যোগমায়া মন্দির। মন্দিরটি উত্তরেশ্বর কালী মন্দির নামে পরিচিত। প্রায় ৭৫ বছর ধরে দাস পরিবারের মন্দিরে পূজিতা হচ্ছেন দেবী যোগমায়া। ঝাড়গ্রাম রাধানগর অঞ্চলের সেবায়তন লাগোয়া ছোট্ট গ্রাম কেঁউদি। সেই গ্রামের পথ পেরিয়েই রয়েছে দেবীর মন্দির।
দেবীর নাম কেঁউদি কালী। জনশ্রুতি অনুযায়ী, জনৈক হাড়িরাম দাস, তন্ত্রসিদ্ধ হয়ে স্বপ্নাদেশে দেবীকে কন্যারূপে পেয়েছিলেন। তিনিই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কেঁউদি গ্রামের তালগাছের সারি ও পুকুর পাড় লাগোয়া মাটির পথ পেরিয়ে কিছুটা গেলেই দেবীর মন্দির।

কথিত আছে, হাড়িরামের ঘরে জন্ম নিয়েছিল এক ফুটফুটে মেয়ে। মাত্র দেড় বছরে অসুস্থ হয়ে রক্তবমি করে মৃত্যু হয় শিশুকন্যার। মেয়েকে হারিয়ে উন্মাদের মতো হয়ে যান হাড়িরাম। গ্রামের কাছেই শ্মশানের মাটি চাপা দিয়ে সমাহিত করা হয় মেয়েকে। সন্তানহারা বাবার মন মেয়ের জন্য কেঁদে উঠত। রাত হলেই শ্মশানে গিয়ে মাটি সরিয়ে মেয়ের দেহ বুকে চেপে কান্নায় ভেঙে পড়তেন তিনি। ভোরের আলো ফোটার আগেই ফিরে আসতেন। এভাবে চলতে থাকে। একদিন হঠাৎই শ্মশানে দেবী যোগমায়ার দর্শন পেলেন হাড়িরাম। দেবী জানালেন, মাটি সরিয়ে প্রতিদিন মেয়ের দেহ দেখতে আসার দরকার নেই। তিনিই অর্থাৎ খোদ দেবী কালীই কন্যারূপে হাড়িরামের বাড়িতে থাকবেন আজীবন।

হাড়িরাম অব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব। দেবীর আদেশে বাড়ির উঠোনে বেলগাছের তলায় পঞ্চমুণ্ডির আসনে সাধনা শুরু করলেন তিনি। সঙ্গী হলেন তিন তান্ত্রিক। এক অমাবস্যায় সিদ্ধিলাভ হল তাঁদের। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, একদিন দেবী দর্শন দিয়ে জানালেন, হাড়িরাম হবেন বাকসিদ্ধ অর্থাৎ তিনি যা বলবেন সেটাই ফলবে। হাড়িরামের বাড়ির উঠোনে পঞ্চমুণ্ডির আসনের পাশে জগতের মঙ্গলময়ী হিসেবে উত্তর দিকে পিঠ করে থাকবেন দেবী। তাই দেবী উত্তরেশ্বরী। ঘটনাচক্রে ওই রাতে রাধানগরের এক মৃৎশিল্পী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে দেবী মূর্তি গড়লেন। কেঁউদির দেবী যোগমায়া চতুর্ভুজা উত্তরেশ্বর কালী। দেবীর উপরের ডান হাতে থাকে খড়্গ। নিচের ডান হাতে তিনি বরাভয় দেন। উপরের বাম হাত মুষ্টিবদ্ধ। নিচের বাম হাতে মনোবাঞ্ছার অভীষ্ট পাত্র থাকে।

১৯৪৯ সালের এক অমাবস্যায় মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালাঘরে যোগমায়াকে প্রতিষ্ঠা করেন হাড়িরাম। হরি কৃষ্ণ হরি রাম, কালী কৃষ্ণ রাম রাম মন্ত্রে দেবীর পুজো করতেন হাড়িরাম। দেবীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। দিনে দিনে ভক্ত সংখ্যা বাড়ল। দেবীর মন্দির তৈরি হল। হাড়িরামের সঙ্গে দেবীর সেবা করতে শুরু করলেন তাঁর স্ত্রী মনোরমা। হাড়িরামের মাথায় প্রকাণ্ড জটা পড়ল। মৃত্যুর আগে তিনি সেই জটা কেটে মন্দিরে রেখে দেন। যা আজও দেবী কালিকার পাশে একটি কাঁচ ঘেরা কাঠের বাক্সে রাখা রয়েছে।

হাড়িরামের পুত্র শিশির দাস এখন দেবীর নিত্যসেবা করেন। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন। হাড়িরামের মৃত্যুর পর মন্দিরের পাশেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর স্ত্রী মনোরমার মৃত্যুর পর, তাঁকেও হাড়িরামের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করা হয়। তৈরি হয়েছে সমাধি মন্দির। মন্দিরে মায়ের মূর্তির পাশে রয়েছে হাড়িরামের মূর্তিও। দেবীর পুরনো মাটির মূর্তির ফি বছর নবকলেবর করানো হয়। কালীপুজোর রাতে প্রচুর ভক্ত আসেন মন্দিরে। ভক্তদের বিশ্বাস, মা তাঁদের ঘরের মেয়ে। ভক্তিভরে মায়ের কাছে প্রার্থনা জানালে, মা ভক্তের কথা শোনেন। সেই বিশ্বাসেই বহু মানুষ আসেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...