বঙ্গদেশ সুদীর্ঘকাল ধরেই বহুধর্মের মিলনক্ষেত্র। বঙ্গের দেবী কালী। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ এই বঙ্গ ভূমিতে স্মরণাতীত কালীর আরাধনা করে আসছে। মধ্যমগ্রামের কাপাসিয়ায় কালী, পুজো পাচ্ছেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরা হাতে। কালী মন্দিরের কাছেই রয়েছে মসজিদ, সৈয়দ হাজী মুরুদ্দীন শা ওয়ারিশ পীরের মাজার।
উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাত মধ্যমগ্রাম অঞ্চল কালী পুজোর জন্য বিখ্যাত। মধ্যমগ্রামেই রয়েছে কাপাসিয়া কালী মন্দির। জনশ্রুতি রয়েছে, দেবী আজ পর্যন্ত এই মন্দির থেকে কাউকেই খালি হাতে ফেরাননি। যে যা মানত করেন, সকলের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন দেবী কালী। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল জানা যায় না। কাপাসিয়া অঞ্চলে কে, কবে কালী প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা আর জানা যায় না। তবে গবেষকদের অনুমান কাপাসিয়ায় প্রায় পাঁচশো বছর ধরে কালীর পুজো চলে আসছে। দেবী দক্ষিণা কালী।
নীলগঞ্জের ঘা ঘেঁষে বয়ে যেত পারন্যবতী নদী। আজ যা ‘নোয়াই খাল’ হিসাবে পরিচিত। নদীর তীরেই ছিল দেবীর থান। দেবী খুবই জাগ্রত। উনিশ শতকে হরিদ্বার থেকে এক সাধু এসে এখানে মায়ের সেবা করতেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। কেবল দীপান্বিতা অমাবস্যায় দেবী কালীর পুজো হত। এখন বছরে দু-বার দেবীর জাঁকজমকপূর্ণভাবে পুজো হয় এক কালীপুজোর দিন, আর ভাদ্র মাসের অমাবস্যার দিন। একদা মুসলমানরাই ব্রাহ্মণ ডেকে পুজো করাতেন।
কোনও এক সময় কাপাসিয়া অঞ্চল ছিল গভীর জঙ্গলে ঘেরা। বহু বছর ধরে সেখানে দেবীর অধিষ্ঠান, থানে পূজিতা হতেন দেবী। কোনও মন্দির ছিল না। কাপাসিয়া গ্রামটি মুসলমান অধ্যুষিত। তাঁরাই মা কালীর ও মন্দিরের দেখভাল করতেন। ফি বছর পুজোর সময়ে কলকাতা থেকে গরুর গাড়ি চেপে পুরোহিতরা আসতেন পুজো করতে। জঙ্গল পরিষ্কার করে পুজোর আয়োজন করা হত। রাতভর পুজো শেষে তাঁরা আবার কলকাতায় ফিরে যেতেন।
১৯৬২ সাল নাগাদ চার-পাঁচটি হিন্দু পরিবার কাপাসিয়া অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তারপর তাঁদের হাতেই এই মন্দিরের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৯৬৬ সালে তৈরি হয় টালির ছাউনির মন্দির। সাতের দশকে যাদবচন্দ্র দে মন্দির গড়ে দেন। মন্দিরে রয়েছে কষ্টিপাথরের দেবী মূর্তি। কথিত, আসল মূর্তিটি কোনও এক সময়ে চুরি হয়ে যায়। পরে আবার পাথরের মূর্তি স্থাপন করে গ্রামের সকলের সহায়তায় মন্দির গড়ে পুজো শুরু হয়। দেবী চতুর্ভুজা। তার পদতলে থাকে শিব। শোনা যায়, বহু অলৌকিক ঘটনারও সাক্ষী এই কাপাসিয়া মন্দির। কালীর মন্দিরের পাশে রয়েছে মনসাদেবীর থান ও মন্দির। এই মন্দিরটি তৈরি হয় ২০১৪ সালে।
এখন কাপাসিয়া কালী মন্দিরে দায়িত্বে রয়েছে একটি কমিটি। বর্তমান পাকা মন্দিরটি ২০০৭ সালে নির্মিত। জনৈক কৌশিক মুখোপাধ্যায় পাথরের শিব লিঙ্গটি দান করেছেন। পাথরের মাতৃ মূর্তি দান করেছেন পুলিনবিহারী পাল। প্রতি বছর বাইশে ফাল্গুন মায়ের প্রস্তর মূর্তির প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে সপ্তসতি চণ্ডী মায়ের মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। অগণিত ভক্তবৃন্দের সমাগম হয়। এছাড়া ভাদ্র মাসের কৌশিকী অমাবস্যার রাতে ও শ্যামাপুজোর রাতে সারারাত ব্যাপী পুজো চলে। প্রতি অমাবস্যার রাতেই মায়ের বিশেষ পুজো হয়। প্রতিদিনই মায়ের নিত্যপুজো ও সন্ধ্যারতি হয়।