প্রান্তিক তথা প্রত্যন্ত অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীর পুজো হয়। আবার চিরাচরিত দেবদেবীর লৌকিক রূপেরও আরাধনা হয়। বন বিবির পুজো হয় বাদাবনে, রাঢ় বঙ্গে বন দুর্গারও আরাধনা হয় কিন্তু বন কালী? হ্যাঁ, তিনিও পূজিতা হন এই বাংলায়। বর্ধমানের কাঁকসার রাজকুসুম গ্রামে প্রায় পাঁচশো বছর যাবৎ বন কালীর পুজো চলে আসছে। দেবী কালিকার কোনও মূর্তি নেই। চারিদিকে জঙ্গল, শাল আর পিয়ালে ঘেরা বনের মধ্যেই গাছকে মা কালী রূপে পুজো করা হয়।
আদিম মানুষ যে প্রকৃতির পুজো করত, সেই ধারাটি আজও অক্ষত আছে এখানে। দীপান্বিতা অমাবস্যার পরের দিন অর্থাৎ কালী পুজোর পরদিন প্রতিপদে এখানে পুজো হয়। সকালে পুজো আরম্ভ হয়, চলে দুপুর অবধি। গোটা বছর, যে বনাঞ্চলে মানুষ যেতে সাহস করে না। সেখানে কালীপুজোর পরের দিন মানুষের ঢল নামে। রাজকুসুম গ্রামের রায় পরিবারের সদস্যরা এই কালীপুজো করে চলেছেন। স্থানীয়দের কাছে দেবী বনকালী নামে পরিচিত।
ভক্তরা মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন। দেবীর কাছে মানত করে যান। মানত পূরণ হলে ছাগল উৎসর্গ করার রেওয়াজ রয়েছে। পুজোর দিন সেই ছাগল বলি দেওয়া হয়। সে'কারণে আজও এই পুজোয় বলিদানের রেওয়াজ রয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে শাল গাছের নিচে শুধুমাত্র ঘট রেখে বনকালীর পুজো হয়। এটি পশ্চিম বর্ধমান জেলার গ্রামীণ কালীপুজোগুলির অন্যতম।
রায় পরিবারের দাবি, পুজোয় বয়স ৫০০ বছরের বেশি। এই পুজোর সঙ্গে গোপালপুরের ভট্টাচার্য পরিবারের যোগ রয়েছে। ভট্টাচার্য পরিবারের বড় কালীর সঙ্গে বনকালীর যোগ রয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রাও। দুই পরিবারের সদস্যদের দাবি, জঙ্গল একদা অত্যন্ত গভীর ছিল। যেখানে বনকালী দেবীর পুজো হয়, সেখানে কেউ যেতে সাহস পেত না। পুরোহিতও ভয়ে ভয়ে পুজো করতে যেতেন। ভট্টাচার্য পরিবারেরই কোনও পুরুষ যেতেন পৌরহিত্য করতে। তিনিই দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। তারপর থেকে ভট্টাচার্য পরিবারে শুরু হয় বড় কালীর পুজো। পুজো হয় দীপান্বিতার পরদিন। কালীপুজোর পরদিন রাজকুসুমের রায় পরিবার থেকে পুজো যায় গোপালপুরের ভট্টাচার্য পরিবারে। সেই পুজো যাওয়ার পরই দেবী বড়কালীর পুজো হয়। তারপর শুরু হয় রাজকুসুমের বনকালীর পুজো।
কথিত আছে, এককালে জঙ্গলের মধ্যে মূর্তি এনে পুজোর আয়োজন হত। পুরোহিত জঙ্গলে গিয়েই পুজো করতেন। এক বছর প্রবল বৃষ্টির জেরে জঙ্গলে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। সে'বছর পুরোহিত স্বপ্নাদেশ পান। দেবী তাঁকে বাড়িতেই পুজো করতে বলেন। প্রায় ১০০ বছর আগে দেবীর নির্দেশ মেনে কাঁকসার গোপালপুর গ্রামে ভট্টাচার্য্য পরিবারে শুরু হয় দেবী কালির পুজো। কিন্তু জঙ্গলে বহু বছর ধরে পুজো হত, পুরোহিত জানতে চেয়েছিলেন জঙ্গলে মূর্তি না থাকলে সেখানে কোথায় পুজো দেবে। দেবী স্বপ্নে জানিয়েছিলেন, জঙ্গলে একটি গাছের গায়ে দুটো চোখের আকৃতি দেখা যাবে সেই গাছেই তিনি বিরাজমান। সে গাছের গোঁড়ায় মূর্তি ছাড়াই পুজো হবে। আজও দেবী কালিকা পূজিতা হন সেই স্বপ্নদেশ মতো।