কালীসাধক কমলাকান্তকে তো সকলেই চেনেন। শাক্তকবি, গায়ক, সাধক, কালীভক্ত কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের আরাধ্যা দেবীর কথাই আজকের কালী কথায় উঠে আসবে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজে চিত্রগঞ্জের শ্মশানেই রয়েছে এক কালী মন্দির। স্থানীয়দের কাছে সেই মন্দির ‘খুকি কালীমন্দির’ নামেই পরিচিত। আটচালা মন্দিরের মধ্যে রয়েছে, কষ্টিপাথর নির্মিত এক ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট চতুর্ভূজা ত্রিনয়না দেবী। কিন্তু মন্দিরে দেবী বিগ্রহের পদতলে শিব অনুপস্থিত। শোনা যায়, বর্ধমান রাজবাড়ি সংলগ্ন এক মন্দির থেকেই উঠিয়ে আনা হয়েছিল দেবী বিগ্রহকে। সেখানেই এই মূর্তির পুজো করতেন কালীসাধক কমলাকান্ত।
আনুমানিক ১৭৬৯ মতান্তরে ১৭৭২ সালে অবিভক্ত বর্ধমানের চাঁপা গ্রামে কমলাকান্তর জন্ম হয়েছিল। খুব অল্প বয়সেই কলমাকান্তের কালী সাধনার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্ধমানের মহারাজ তৈজশচন্দ্রের অর্থাৎ মহারাজ তেজচাঁদ কমলাকান্তকে নিজের রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বর্ধমান রাজবাড়ির অনতিদূরে বোরহাট অঞ্চলে মহারাজ তেজচাঁদ কমলাকান্তকে একটি মন্দির তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মন্দিরেই কালী সাধনার জন্যে এক হাত লম্বা এক পাথরের কালীমূর্তি স্থাপিত হয়। দেবী মূর্তি এখানে অনন্য, অন্যান্য সাধারণ পরিচিত কালীমূর্তির থেকে একটু আলাদা। মাতৃমূর্তির পায়ের তলায় নেই শিব। জনশ্রুতি রয়েছে, কমলাকান্ত নাকি শায়িত অবস্থায় নিজের বুকের ওপর মাতৃ মূর্তি রেখে দেবীর আরাধনা করতেন। ১৮২১ সালে বোরহাটে মারা যান সাধক কমলাকান্ত। তবে থেকে যায় মন্দিরটি। নিয়ম মেনে পুজো পাঠ চলত।
এর বেশ কিছু বছর পরের কথা, ওই মন্দিরে ডাকাতি হয়। ডাকাতি করে ফেরার পথে ডাকাত দলের ডাকাত সর্দার পথের বিতরণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। জলের জন্য ডাকাত দল হাজির হয় সাধক দয়াল ঠাকুরের কুটিরে। ডাকাত দলের কাছে কালী মূর্তি দেখে, ডাকাত-সর্দারকে ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন তারা কি দেবীকে জল, বাতাসা দিয়েছে। ডাকাত সর্দার বুঝতে পারলেন দেবী তাদের উপর রুষ্ট হয়েছেন। দেবীর রোষে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। না, আর সময় নষ্ট করা কষ্ঠিপাথরের তৈরি সেই মূর্তি সাধকের কাছে রেখেই চলে গেলেন ডাকাতরা।
গঙ্গা তীরের ছোট্ট কুটিরে জায়গা হল দেবীর। পরবর্তী অমাবস্যাতেই শ্মশানের মধ্যে পঞ্চমুণ্ডির আসনে প্রতিষ্ঠিত হলেন দেবী। দয়াল ঠাকুরের গুরু স্বামী পূর্ণানন্দ প্রতিষ্ঠা করলেন মাকে। ঘটনা ঘটে ছিল, অনুমানিক ১৮৯২ সালে। বজবজে দেবী বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর দয়াল ঠাকুর মন্দিরের পুজোর জন্য ফুল্লরাপীঠের পুরোহিত রামজী সাধুকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তান্ত্রিক জীবনের আগে এই দুই সাধকই ব্রিটিশ বাহিনীতে কাজ করতেন। সেই সময় থেকেই তাদের পরিচয়। অযোধ্যা নিবাসী বলভদ্র পাণ্ডে অর্থাৎ রামজী সাধু বেশ কিছু বছর বজবজের শতাব্দীপ্রাচীন এই কালীমন্দিরে ছিলেন। বিগ্রহের আকারের কারণেই 'খুকী মাঈ' বলে দেবীকে ডাকতেন রামজী সাধু। তা থেকেই ছোট্ট মফস্বলে 'খুকী মা' হিসাবে বিখ্যাত হন দেবী।
তবে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠার অন্য এক কাহিনী শোনা যায়। অন্য জনশ্রুতি অনুসারে, কোন একদিন ভােররাত্রে বর্ধমানের মহারাজা তেজেন্দ্রচন্দ্র এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন। মা কালী বালিকারূপ ধারণ করে তাঁর সভাকবি সাধক কমলাকান্তর সঙ্গে খেলা করছেন। মহারাজা তখনই ছুটলেন কমলাকান্তের কাছে, সাধক কমলাকান্তর অম্বিকা কালনায় থাকতেন। ভোরবেলা স্বপ্নের কথা তিনি জানালেন, আরও জানালেন, তাঁর অনুমতি পেলে মায়ের অনুমতি পেলে ওই রূপ মূর্তি করার ইচ্ছা তাঁর। কমলাকান্ত মায়ের আদেশ পালন করতে বললেন। এক খন্ড কালো কষ্টিপাথর খোদাই করে ব্রহ্মময়ী কালীমূর্তি নির্মিত হল। এক অমাবস্যা তিথিতে মহারাজা তেজেন্দ্রচন্দ্র সাধক কমলাকান্তের হাতে ব্রহ্মময়ী কালীমূর্তিটি সমর্পন করলেন।
তবে শোনা যায়, মূর্তি নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়ার আগে, ১৮০৯ সালে সাধক কমলাকান্ত অম্বিকা কালনা থেকে রাজবাড়ির কাছে কোটালহাটে সস্ত্রীক এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। মূর্তিটি কমলাকান্তর কোটালহাটে বাড়িতে স্থাপিত হয়েছিল। শোনা যায়, দেবী মায়ের বালিকারূপে মুগ্ধ ভক্তরা মায়ের নাম দেয়, "খুকিকালী"।
কথিত রয়েছে, ১৮২১ সালে সাধক কমলাকান্তর মৃত্যুর পর, কমলাকান্তের এক তন্ত্রশিষ্য রামকালী খুকিকালীর প্রস্তরমূর্তি নিজের বুকে বেঁধে বিভিন্ন শক্তিক্ষেত্রে তীর্থপরিক্রমায় বের হন। রামকালীর মৃত্যুর পর, রামকালীর এক তন্ত্রশিষ্য কালিপদগুরুর একই পথ অনুসরণ করেন। কালিপদও খুকিকালীর প্রস্তরমূর্তি নিজের বুকে বেঁধে কঙ্কালীতলা, তারাপীঠ, কামাখ্যা ও পূর্ব ভারতের প্রায় সব শক্তিক্ষেত্রে তীর্থপরিক্রমার পর বৃদ্ধ বয়সে কালীক্ষেত্র কালীঘাটে আসেন ও তারপর দক্ষিণমুখী হন। অসুস্থ বোধ করায় কালিপদ বজবজ ফেরিঘাটে নৌকা থেকে নেমে যান। শশ্মানসাধক স্বামী পূর্ণানন্দ বৃদ্ধ অসুস্থ কালিপদকে আশ্রয় দিলেন। সেখানেই প্রতিষ্ঠা পেলেন মা। আজও এই মন্দিরে পূজিত হচ্ছেন মা।