বাংলার কালী সাধকরা গঙ্গার তটকেই বেছে নিয়েছিল কালীসাধনার ক্ষেত্র হিসেবে। নদী তীরবর্তী অঞ্চল যেকোন ধরণের সাধনার জন্যই উৎকৃষ্ট স্থান বলে বিবেচিত হয়। বহু কালী সাধকেরাই সাধনার স্থান হিসেবে আদি গঙ্গার পাড়কে নির্বাচন করেছিল। আদি গঙ্গার তীরে গড়ে উঠেছিল একাধিক কালী মন্দির। তেমনই এক মন্দিরের কথা বলি। প্রায় কয়েকশো বছর আগে আদি গঙ্গার পাড়ে তৈরি হয়েছিল এই মন্দির। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মন্দির বাজার থানা এলাকার দক্ষিণ বিষ্ণুপুর অঞ্চলে রয়েছে এক অতি প্রাচীন শ্মশান। জনশ্রুতি রয়েছে, কোনও এক সময়ে বহু সন্ন্যাসী বা তান্ত্রিক সেই কালী ক্ষেত্রে সাধনা করতে আসত। সেই শ্মশানেই তৈরি হয়েছে এই মন্দির। শোনা যায়, এক সময় এখানে শব সাধনাও চলত। লোকমুখে শোনা যায়, প্রতি রাতে এ তল্লাটে নাকি অপঘাতে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা ঘুরে বেড়ায়। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, আজ থেকে প্রায় ১০৯ বছর আগে এখানেই দেবীর পুজো আরম্ভ করেন তান্ত্রিক মণিলাল চক্রবর্তী। তন্ত্র মতে মায়ের আরাধনা শুরু করেন তিনিই। ১০৮টি নরমুণ্ড দিয়ে মা কালীর আরাধনা করতেন মণিলাল চক্রবর্তী। দেবী এখানে করুণাময়ী কালী রূপে পুজো পান। টালির চালের মন্দিরে শুরু হয়েছিল মাতৃ আরাধনা। সে সময় এই অঞ্চল ছিল ছোট্ট এক জনপদ। অতীতের টালির চালের মন্দির জায়গায় এখন পাকা দালান তৈরি করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান মণিলাল ছোটবেলা থেকে ঈশ্বর ভক্ত। পুজো-আচ্চার মনও ছিল ছোটবেলা থেকেই। বড় হতেই তন্ত্রসাধনায় খুঁজে পেলেন আকর্ষণ। সেই আগ্রহ থেকেই বিষ্ণুপুর শ্মশানেই শুরু করেন তন্ত্রের পাঠ। জনশ্রুতি রয়েছে, মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মণিলাল। স্বপ্নে মা কালী তাঁর কাছে নাকি নিত্য পুজো পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং পুজো শুরু করতে বলেন।১০৮টি নরকরোটিতে পুজো শুরু হয়। আজও পুজোর জন্যে তন্ত্র মত মেনে নরমুণ্ড জোগাড় করা হয়। তার সবকটিই হতে হবে অপঘাতে মৃতদের, সেইভাবেই জোগাড় করা হয়। এটাই এই মন্দিরের বিশেষত্ব। পুজোর জন্যে পঞ্চ মুণ্ডির আসন তৈরি করা হয়। তন্ত্র মতে পুজো হলেও এখানে বলি হয় না। মন্দিরে প্রথম দিন থেকেই কঠোরভাবে বলি প্রথা নিষিদ্ধ। কার্তিক মাসে কালীপুজোর রাতে মদ, কাঁচা মাংস ও ছোলা দিয়ে ডাকিনী যোগিনীর পুজো করা হয়। শিয়ালের ভোগ অর্থাৎ শিবাভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে।
চক্রবর্তী পরিবার আজও দেবীর উপাসনার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এখানে পুজোর পুরোটা জনসমক্ষে হয় না। পুজোর কিছু অংশ জনসমক্ষে হলেও, দেবী কালিকার উপাসনার মূল অংশ হয় রুদ্ধ দ্বারের ভিতরে, সেখানে কেউ থাকেন না। জনশ্রুতি রয়েছে, আজও এখানে শব সাধনা হয়। মধ্যরাতে মন্দিরের সেবায়েত নাকি শ্মশান জাগানোর খেলায় মেতে ওঠেন।
আগেই বলেছি আদি গঙ্গার তীরে কালীর আরাধনা শুরু করেছিলেন তান্ত্রিকেরা। শ্মশান লাগোয়া জায়গায় চলত তন্ত্র সাধনা। গঙ্গার ধারে জঙ্গলের পাশে নির্জন শ্মশান ছিল তন্ত্র সাধনার আদৰ্শ স্থান। আরেক শ্মশানের গল্প বলি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরের সাতঘরা ঠাকুরঝি গ্রামে রয়েছে যজ্ঞবাটি মহাশশ্মান। সেখানেই অবস্থিত তিন চূড়া বিশিষ্ট মন্দিরে কয়েকশো বছর ধরে পূজিতা মা যজ্ঞেশ্বরী।যজ্ঞবাটি শ্মশানের মা যজ্ঞেশ্বরী।
কথিত আছে, এই স্থানেই নাকি একদা স্বয়ং চৈতন্য দেবের শ্রীচরণের ধুলো পড়েছিল। এক সময়ে ছত্রভোগ হয়ে নীলাচলে যাওয়ার পথে এই শ্মশানে নাকি বিশ্রাম নিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। যদিও ইতিহাসবিদদের মতে, এই ঘটনার কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। গড়িয়া যেখানে মহাপ্রভুর চরণ পেয়েছে, সেখানে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই শ্মশানে মহাপ্রভুর পদধূলি পড়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়। এক সময় এই শ্মশানে বৈষ্ণব ও বৈরাগী সম্প্রদায়ের মানুষদের সমাধি দেওয়া হত বলেও শোনা যায়। কথিত আছে, বৈরাগীরা এই সমাধিস্থলকে যজ্ঞবাড়ি বলে ডাকতে আরম্ভ করায়। যজ্ঞবাড়ি নামটি খ্যাতি পায়, সেই থেকেই কালক্রমে এলাকার নাম হয়ে ওঠে যজ্ঞবাটি। পরবর্তীকালে অপঘাতে মৃত শিশুদের এই শ্মশানে সমাধিস্থ করা হত। এই শ্মশান পরবর্তীকালে সুন্দরবন অঞ্চলের তান্ত্রিকদের সাধনা স্থল হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তান্ত্রিকরা আসতে আরম্ভ করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, প্রথম এখানে সাধনা করতে আসেন তান্ত্রিক শিবানন্দ ব্রহ্মচারী। ১০৮টি নরমুণ্ড দিয়ে তন্ত্র মতে মায়ের আরাধনা শুরু করেন। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে মায়ের মন্দির। পরবর্তীকালে অপঘাতে মৃত শিশুদের সমাধিস্থ করা হত এই শ্মশানে। তান্ত্রিক শিবানন্দ ব্রহ্মচারীর মৃত্যুর পর মায়ের সেবার দায়িত্ব নেন এক মহিলা সাধু। তাঁর মৃত্যুর পর মন্দিরের দায়ভার গ্রামবাসীরাই কাঁধে তুলে নেন। যজ্ঞবাটি খুবই ইতিহাস প্রসিদ্ধস্থান, এই স্থান নিয়ে পৌরাণিক গল্পও রয়েছে। প্রচলিত পৌরাণিক ইতিহাস অনুযায়ী, স্বর্গ থেকে গঙ্গা নিয়ে আসার সময় ভগীরথ এখানেই বিশ্রাম নিয়েছিলেন। যজ্ঞও করেন ভগীরথ। একটি কিংবদন্তি বলে, ভগীরথের করা যজ্ঞের সুবাদেই এই স্থানের নাম হয় যজ্ঞবাটি। দেবী এখানে তন্ত্র মতেই পূজিতা হন। দেবীর নৈবেদ্যে মদ, মাংস, কাঁচা ছোলা দেওয়া হয়। কোনও রকম বলি হয় না এখানে। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস মা যজ্ঞেশ্বরী খুব জাগ্রত। কালীপুজোর দিন এখানে মহা সমারোহে পুজো করা হয়। বিপুল জনসমাগমও হয়।