বীরভূম হল কালী ক্ষেত্র। রবি ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত জেলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য শতাব্দীপ্রাচীন কালীমন্দির। কালীপুজোয় এক অন্য সাজে সেজে ওঠে গ্রাম। এখানকার পুজোর রীতিনীতি একেবারে আলাদা। বীরভূমের সিউড়ির ইন্দ্রগাছা গ্রামের কালী মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম ইন্দ্রগাছা বামা কালী মন্দির। কথিত আছে, প্রায় ৫০০ বছর আগে সাধক রামকানাই হরকুনার গভীর জঙ্গলে মায়ের সাধনা করার সময় মাতৃ মূর্তির দর্শন পান। তিনি সঙ্গে সঙ্গে একটি কাঁসার থালায় সেই মাতৃ রূপ এঁকে ফেলেন। সেই রূপের ছবি দেখে বানানো হয় তাঁর মাটির মূর্তি। ওই রূপে প্রায় ১৩ ফুট উচ্চিতার মূর্তি গড়ে বামা কালীর পুজোর সূচনা হয়। আজও সেই পুজো হচ্ছে। কালীপুজোয় গভীর রাতে মানুষের ঢল নামে ইন্দ্রগাছা গ্রামে।
কথিত রয়েছে, যে থালায় মায়ের জীবন্ত রূপ দেখে ছবি এঁকেছিলেন সাধক, সেই থালা গোপনে সযত্নে রেখে দিয়েছেন ইন্দ্রগাছা গ্ৰামের বাসিন্দারা। লোকমুখে শোনা যায়, ইন্দ্রগাছার এই বামাকালী ৫০০ বছর ধরে পূজিতা হয়ে চলেছেন। সাধক রামকানাই পুজোর জন্য মন্ত্রও রচনা করেছিলেন। মন্ত্র লেখা পুঁথি রামকানাইয়ের পুঁথি নামে পরিচিত। দীপান্বিতা অমাবস্যাতে ধুমধাম করে কালীর পুজো হয়। তবে বাংলার অন্যান্য কালীর চেয়ে এই কালী একটু আলাদা। সাধারণত কালীর ডান পা শিবের বুকে থাকে কিন্তু ইন্দ্রগাছার কালীর বাম পা শিবের বুকে থাকে তাই একে বামা কালী নামে অভিহিত করা হয়েছে।
এখানে পুজোর দিনেই মায়ের চক্ষুদান হয়। মূর্তিতে রঙের প্রলেপ পড়ে। পুজোর দিনেই গায়ের রঙ ও চক্ষুদান করা প্রাচীন প্রথা। গায়ের রঙ করা হয় কাঠে আগুন জ্বালিয়ে তৈরি ভুসোকালি থেকে। প্রতিমা গড়া হলে মাতৃমূর্তি মূল মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। প্রায় ৬০ জন মানুষ ৪০ ফুট লম্বা লাল শাল কাঠের বেদিতে চাপিয়ে মাকে মূল মন্দিরে নিয়ে আসেন। এই দৃশ্য দেখার জন্য প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। তারপর প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুধু এখানেই শেষ নয়, মন্দির চত্বরে মাকে পালা গান শোনানো হয়। গান শুনে তবেই পুজো গ্রহণ করেন তিনি। বহু বছর ধরে এই নিয়মেই চলে আসছে পুজো। শতাধিক ভক্তর কাঁধে চড়ে মূর্তি গড়ার মন্দির থেকে পুজোর মন্দিরে পাড়ি দেন সিউড়ির ইন্দ্রগাছার বামা কালী। তা দেখতেই ভিড় করেন হাজার হাজার মানুষ। রাস্তার দু-পাশে বহু মানুষ সার বেধে দাঁড়িয়ে থাকেন।
দেবী এখানে চতুর্ভুজা। হাতে থাকে নরমুণ্ড। দেবীর বাঁ হাতে কদমা রাখা হয়। পদতলে শিব থাকেন। মাতৃ মূর্তির বর্ণ অমাবস্যার নিকষ রাতের মতো কালো। বামা কালীর পুজোয় আজও মানত করে বলি দেন বহু মানুষ। এক রাতেই একশোর বেশি বলিদান হয়। পাঁচশো বছরের পুরনো এই পুজো রাঢ় বাংলার এক বিস্ময়। এখানে প্রতিমান নিরঞ্জন হয় ভাইফোঁটার দিন। পাঁচশো বছর ধরে একই রীতি মেনে পূজিতা হয়ে আসছেন বিশালাকার মা বামা কালী।