'হ্যাবড়' থেকে ইংরেজদের 'হাওড়া'

বয়ে চলা নদীর দু'পারে গড়ে উঠেছে দুই সমৃদ্ধশালী নগর। পূব তীরে কলকাতা, আর পশ্চিমে হাওড়া। কালীঘাট, সুতানটি আর গোবিন্দপুরের মতো এই পশ্চিম তটে ছিল বেতড়, শালিখা, হারিরা, কাসুন্দিয়া, রামকৃষ্ণপুরের মতো ছোট ছোট গ্রাম। যেগুলো নাম, রূপ পাল্টে ধীরে ধীরে মিশে গিয়েছে হাওড়া শহরে।

 

কলকাতা শহরের মতো হাওড়ারও নাম নিয়ে নানা ধরণের মতামত রয়েছে। বর্তমানে হাওড়া জেলা বা শহরের আগে কী নাম ছিল? কীভাবে হাওড়া শব্দটির বুৎপত্তি হল? সেসব জানতে হলে আমাদের কয়েক শতাব্দী পিছনে ফিরে তাকাতে হবে। তাহলে কিছুটা হলেও জানা যাবে। কিছুটা বলছি এই কারণে যে, এখনও নাম নিয়ে গবেষণার অবকাশ রয়ে গিয়েছে।

Howrah1

সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতক। দিল্লির তখত সামলাচ্ছেন বাদশা ফারুকশিয়ার। সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র। সেই সময় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। দিল্লি দরবারের দেওয়ান মহম্মদ হাদী আওরঙ্গজেব দ্বারা 'মুর্শিদকুলি' উপাধি নিয়ে বাংলা সামলাচ্ছেন।

 

এই সময়কালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির বাদশার কাছে গঙ্গা নদীর পূর্বতীরের তেত্রিশটি গ্রামের ইজারার জন্য আর্জি জানায়। সেই সঙ্গে পশ্চিমপাড়ের পাঁচটি গ্রামের ইজারার জন্যও আবেদন পেশ করা হয়। কোম্পানির কাউন্সিলর বইয়ে পাঁচটি গ্রামের নাম লেখা রয়েছে যথাক্রমে 'Salica', 'Harrirah', 'Cassundeah', 'Ramkrishnapur' এবং 'Battor'।

 

দিল্লির বাদশা বার্ষিক খাজনা ১৪৫০ টাকা ধার্য করেন। সেই অনুযায়ী ফরমানও জারি করা হয়। তবে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ বেঁকে বসেন। তিনি পাঁচটি গ্রামের জমিদারদের ব্রিটিশ দের কোনরকম অধিকার দিতে বারণ করেন।

Howrah2

সেই নির্দেশানুসারে জমিদাররা গ্রামের অধিকার ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বাংলায় দিল্লির শাসন ছিল নাম মাত্র। কার্যত বাংলা সব বিষয়ে ছিল স্বাধীন। ফলে দিল্লির বাদশাহী ফরমান অনুযায়ী ইজারা বাংলায় কার্যকরী করা সম্ভব হয়নি।

 

এরপর মীর কাশিম বাংলার নবাব হলেন। সিংহাসনে বসেই বর্ধমান, মেদিনীপুর আর চট্টগ্রাম জেলার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। সেই সময় হাওড়া ছিল বর্ধমান জেলার অন্তর্ভুক্ত। স্বভাবতই হাওড়া ব্রিটিশ এলাকায় পরিণত হয়।

 

এই সময় "হারিরা" নামটি বিকৃত বিদেশি উচ্চারণে "হাওড়া" হয়েছে কিনা সে নিয়ে নানান গবেষকের নানান মতামত রয়েছে।
অনেকে এর সপক্ষে যুক্তি হিসেবে দেখিয়েছেন বর্ধমান বিকৃত উচ্চারণে হয়েছে "বার্ডওয়ান"।

 

ড: নীহার রঞ্জন রায়ের মতে "হাওড়া" কথাটির শেষে 'ড়া' শব্দটি দ্রাবিড় ভাষার স্বাক্ষর বহন করে। সে ভাষায় "হাওড়" শব্দের অর্থ জলা জায়গা। দলিলপত্রে একসময় হাওড়া শহরের একাংশকে পরগণা বোরো বলে উল্লেখ করা হত। "বোরো" শব্দের অর্থ জলমগ্ন জায়গা।

Howrah3

মালী পাঁচঘড়ার কাছে একটি বড়ো কর্দমাক্ত অঞ্চল ছিল। যাকে ডাকা হত "হাওড়া"। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে শুধু হাওড়া শহরের অন্তর্গত সাড়ে আট বর্গ মাইল এলাকায় খানা ডোবার সংখ্যা ছিল ১৮০০টি।

 

মনে করা হয় বাংলায় আর্য বসতি বিস্তারের আগে যে আদিম অধিবাসীদের সন্ধান পাওয়া যায়, তার মধ্যে দ্রাবিড় জাতির লোকেরাই হয়ত এই অঞ্চলে ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। খাল, বিল, দহ, ডোবা ও জলা জায়গার জন্য এই জায়গার নাম দেওয়া হয়েছিল 'হাওড়া'।

 

"The Origin And Development Of the Bengali Language" গ্রন্থে ভাষাচার্য্য ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় "ড়া" প্রত্যয়টিকে অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর শব্দ বলেছেন। "ড়া" প্রত্যয়টি 'ওড়াক' শব্দ হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। যার অর্থ বাড়ি। জলা জায়গার বাড়ি অর্থে হাওড়া অর্থাৎ হাওড়+ড়া=হাওড়া। কোল ভাষাগোষ্ঠীতে "আড়া" শব্দের অর্থ বাঁধের পাড়। পুকুরের আড়া মানে পুকুরের পাড়। জল ঘিরে রাখার জন্য উঁচু ডাঙ্গা বা বাঁধ।

Howrah4

শ্রী তারাপদ সাঁতরার মতে, "হারিরা" নয় অঞ্চলটির নাম ছিল "হাড়িয়ারা"- হাড়ি বা হাঁড়া+আড়া যার অপভ্রংশ হাওড়া।

 

'Habor' এই ইংরেজি শব্দটির অর্থ 'হোঁচট খাওয়া'। এই অঞ্চলের ঝোপ-ঝাড়, খানা-খন্দে হোঁচট খেয়ে ইংরেজরা হাওড়া নামটি করে ফেলেছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না।

 

"হাওড়া" নামটি নিয়ে নানান মুনির নানান মত থাকলেও একসময়ের জলা জায়গা আজ তার প্রাচীনত্ব আর ইতিহাস নিয়ে বটবৃক্ষের মতো ঝুড়ি বিস্তার করে স্বমহিমায় ভীষণভাবে একটি প্রাণবন্ত শহর হয়ে উঠেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...