পঞ্চদশ শতাব্দী। আফ্রিকা মহাদেশের উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতে আসার জলপথ ইউরোপীয়দের জানা হয়ে গেছে। ফলে ভারতে বাণিজ্য করার লোভ নিয়ে ইউরোপীয় বণিকরা দলে দলে আসা শুরু করেছে। আমরা সবাই জানি সবার প্রথমে এসেছিল পর্তুগীজ। ব্যবসা করতে এসে জলদস্যুতে পরিণত হওয়া পর্তুগীজরা হাওড়ার মানুষদের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছিল। কী হয়েছিল তাই নিয়েই আজকের লেখা।
পূর্ব-ভারতে ঘাঁটি হিসেবে প্রথমে বেছে নিয়েছিল গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের হাওড়াকে। হাওড়ার বেতড়ে তাঁরা নোঙর ফেলে। ব্যবসা বাড়লে তাঁরা ক্রমে শালকেতেও নিজেদের ঘাঁটি গড়ে তোলে। পর্তুগীজদের জাহাজগুলি সপ্তগ্রাম পর্যন্ত না গিয়ে বেতড়ে এসেই থেমে গেল কেন? তা নিয়ে নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। তার জন্য ষোড়শ শতাব্দীর সিজার ফ্রেডরিকের লেখার উল্লেখ করা দরকার। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, বেতড়ের কাছে সরস্বতী ও দামোদরের জলধারা গঙ্গায় পড়ে ব-দ্বীপের সৃষ্টি করেছিল। পর্তুগীজদের সমুদ্রগামী জাহাজ নদীপথে এগোবার সুযোগ না পেয়ে সেখানেই নোঙর করত। শুধু ছোট ছোট জলযানগুলি সপ্তগ্রাম বন্দর পর্যন্ত যেত।
কয়েক বছরের মধ্যেই পর্তুগীজদের অনুসরণ করে ডাচ, ইংরেজ, ফরাসীরাও সমুদ্রের নোনাজল পেরিয়ে গঙ্গার মিষ্টি জল ছুঁতে ছুটে এল। এদিকে সবার প্রথমে এসেও পর্তুগীজরা সেভাবে সুবিধা করে উঠতে পারেনি। ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে অবশেষে তারা জলদস্যুতার পথ বেছে নেয়। বাংলার অন্যান্য জেলার মতো হাওড়ার মানুষরাও বিদেশি জলদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।
নদী তীরবর্তী ৪০-৫০ মাইল দূরের গ্রাম থেকে লোক ধরে এনে ওড়িশা আর দাক্ষিণাত্যের বন্দরগুলিতে ইংরেজ আর ফরাসিদের কাছে বিক্রি করে দিত। এই কাজে তাঁরা আরাকানী মগদের সাহায্য পেত। হাওড়ায় পর্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচারের কথা দিল্লির দরবারে পৌঁছয়। বাদশা শাজাহান তখন দিল্লির মসনদে রয়েছেন। এই মুলুকের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
১৬২৮ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস। বাদশাহী ফরমান জারি করে কাশিম খাঁকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হল। হুগলির কুঠি দখল করে পর্তুগীজদের ধ্বংস করে সাদা চামড়ার স্ত্রী, পুরুষ, শিশু সকলকে বন্দী করে মুসলমান, নয়তো ক্রীতদাস করে পাঠানোর হুকুম দিলেন বাদশা। কাশিম খাঁ কিন্তু বাদশাহী নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন।
বাংলায় শাসনভার নিয়ে কাশিম খাঁ এলেন। এসে বুঝতে পারলেন পর্তুগীজরা ডাঙ্গার থেকে জলে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। ডাঙ্গা থেকে তাঁদের তাড়ালে জাহাজে করে নদী পেরিয়ে সমুদ্রে গিয়ে আস্তানা গাড়বে। বাদশাহী নির্দেশ মতো পর্তুগীজদের শায়েস্তা করার জন্য কাশিম খাঁ এক পরিকল্পনা করলেন। সেই মতো তিনি হুগলি থেকে কিছু দূরে ডাঙ্গায় সৈন্য নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঢাকার দক্ষিণে শ্রীপুর থেকে ঈশা খাঁর (আকবরী আমলে বারো ভুঁইয়ার এক ভুঁইয়া) নাতি মাসুম খাঁ নৌবহর নিয়ে কলকাতার দশ মাইল দক্ষিণে হাওড়ার সাঁকরাইলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ জুন। মাসুম খাঁ সাঁকরাইল এসে পৌঁছলেন। নৌকার সেতু তৈরি করে মোগল বাহিনীর নদী পার হয়ে বেতড় থেকে হুগলির দিকে নদীর দু'পাশে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে কামান সাজিয়ে শত্রুর অপেক্ষায় রইল। অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে এপাড় থেকে ওপাড় পর্যন্ত লোহার শেকল বাঁধা হয়।
পর্তুগীজ জাহাজের সমুদ্র যাত্রার পর বন্ধ করে কাশিম খাঁ হুগলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ১৫ সেপ্টেম্বর দখল করে। পর্তুগীজ ঘাঁটি ধ্বংস হল। কাশিম খাঁ বাদশাহের মর্যাদা বাড়ালেন কিন্তু হাওড়ার মানুষকে স্বস্তি দিতে পারেননি। নদী তীরবর্তী গ্রামগুলি থেকে মানুষ চুরি করা পুরোদমে চলতে লাগল।
জলদস্যুদের দখলের জন্য ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় অবস্থিত মেকিয়া কেল্লা বা দান মাকুয়া দুর্গটিকে মজবুত করে গড়া হয়। এই দুর্গও হাওড়াবাসীদের শান্তি দিতে পারে নি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, দুর্গের দক্ষিণে নদীতে কেউ চান করতে বা রাতে আলো জ্বালাতে সাহস পেত না। এরপর ইংরেজরাও এসে হাজির হয়। সেই গল্প পরের পর্বে লিখব।