কালীর অজস্র রূপ বঙ্গে পূজিত হয়। কোথাও বামাকালী, কোথাও দক্ষিণাকালী, শ্যামাকালী, কৃষ্ণকালী নানা বিধ। নাম করতে গেলে শেষ হবে না। তেমনই নানা সংখ্যক হাত বিশিষ্ট কালীও পূজিত হয়। কোথাও তিনি দ্বিভূজা আবার কোথাও তিনি চতুর্ভুজা। তেমন এক কালীর কথা আজকের কালী কথায় বলব, তিনি হলেন হাজার হাত বিশিষ্টা। হাওড়ার শিবপুরের ওলাবিবিতলায় হাজার-হাত কালীর মন্দির অবস্থিত। শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরে প্রতি বছর মহাধুমধাম করে পুজোর আয়োজন করা হয়।
মন্দিরকে ঘিরে জনশ্রুতির অন্ত নেই। শোনা যায়, এই মন্দিরে প্রার্থনা করে এক দক্ষিণ ভারতীয় ব্যক্তি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছিলেন। ঘটনাটি ঠিক কী? প্রায় ৬০ বছর আগের কথা। শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের এক শুক্রবার দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা কৃষ্ণা সুব্রহ্মণ্যম এই মন্দিরে এসেছিলেন। তখন তিনি ছিলেন দৃষ্টিহীন। হাজার-হাত কালীর কাছে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ার প্রার্থনা করে, তিনি পুজো দেন। এক বছরের মধ্যেই তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। তারপর থেকে তিনি দক্ষিণ ভারত জুড়ে মায়ের মাহাত্ম্য প্রচার আরম্ভ করেন। আজও বিপুল সংখ্যক দক্ষিণ ভারতীয় শ্রাবণে শুক্লপক্ষের শুক্রবারে এই মন্দিরে পুজো দেন।
জনশ্রুতি রয়েছে, কলকাতার চোরবাগানের আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগেই এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় লোকমুখে তান্ত্রিক আশুতোষ তর্করত্ন নামে পরিচিত ছিলেন। আশুতোষ ছিলেন ধর্মপ্রাণ। পুজোপাঠ, ধ্যান, সাধনা নিয়ে থাকতেন তিনি। দেশের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। এক বার স্বপ্নে কালীর এই হাজার-হাতের রূপ দেখতে পান আশুতোষ। ওলাবিবিতলায় আজ যেখানে এই মন্দির গড়ে উঠেছে, সেই জায়গাটিরও স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সেই স্বপ্নাদেশ মতো মন্দির গড়ার জন্য ১২৫ টাকায় হালদার পরিবারের কাছ থেকে ৩ কাঠা জমি কিনে মাটির মন্দির তৈরি করেন আশুতোষ। ১৮৭০ সালে সেই মন্দির গড়ে ওঠে। কুমোরটুলির প্রিয়নাথ পাল বিগ্রহ বানান। চণ্ডীপুরাণ অনুযায়ী, অসুর বধের সময়ে দেবী দুর্গা অনেক রূপ ধারণ করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম তাঁর হাজার-হাতের রূপ। চণ্ডীপুরাণের সেই বর্ণনা মতো হাজার-হাতের কালী মূর্তি তৈরি করা হয়।
অন্য একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, প্রথমে মাটির মন্দির তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু তা তৈরির সামর্থও ছিল না আশুতোষের। সেই সময় মন্দির নির্মাণের জন্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন স্থানীয় হালদার পরিবার এবং স্থানীয় মানুষেরা। মাটির প্রতিমা তৈরি করে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল হাজার-হাত কালীমন্দির।
ভিন্ন একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, ১৯১৪ সালের বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তান্ত্রিক আশুতোষ তর্করত্ন এই মন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন ও কুমারটুলির প্রিয়নাথ পাল বিগ্রহের রূপদান করেন। এই বিগ্রহ মার্কণ্ডেয় পুরাণের মধ্যম চরিত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শ্লোকানুসারে নির্মিত যেখানে দেবী মহিষাসুর বধে উদ্যত। বিশালাকার দেবী বিগ্রহটির এক হাজার হাত বর্তমান ও ডান পা সিংহের পিঠে। প্রতি বছর বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে এই মন্দিরে বিশেষ পুজো হয়ে থাকে।
এই মন্দিরের মাতৃ রূপ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, পুরান মতে, অসুর নিধনের সময় মা দুর্গা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছিলেন। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ নম্বর শ্লোকে সহস্ত্র হাত দেবীমূর্তির বর্ণনা রয়েছে। যে মূর্তির বিশালাকার রূপ দেখে স্বয়ং মহিষাসুর চমকে উঠেছিলেন ও তাঁর হাতে বধ হয়েছিলেন। মায়ের এই রুপটিই হাজার হাত কালী নামে পরিচিত। হাওড়ার শিবপুরের ওলাবিবিতলায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই হাজার হাতের মা কালীর পুজো হয়ে আসছে।
মন্দিরটি চাঁদনী শ্রেণীর স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। মন্দিরের উত্তর দেওয়ালের কিছু সামনে রূপোলী কেশর জুক্ত হলুদ রঙের পা মুড়ে বসা সিংহের ওপর দেবীর বাম পদ বিরাজমান। দক্ষিন পদের অবস্থান এক মহাপদ্মের উপরে। দেবীমূর্তি উচ্চতায় বারো ফুটের মতো। মূর্তির বাম হাত খড়গ এবং ডান হাতে পঞ্চশূল রয়েছে। বিগ্রহের গাত্রাবর্ণ সবুজ। পরনে লালা পাড়যুক্ত সাদা শাড়ী। দুই কাঁধে দুই সর্পফনা, মাথায় পঞ্চপুষের মুকুট। তার কিছু ওপরে রাজচ্ছত্র। দেবীর হাতে বলয়, কানে কানপাশা এবং নাকে নথ। ত্রিনয়নী প্রতিমার তেজপূর্ন চোখের দিকে তাকালে ভয় লাগবে। দেবীর মুখে লোল জিহ্বা প্রলম্বিত নয়, প্রশান্ত। এখানেই ভয় কাটতে পারে।
এই মন্দিরে বলিদানের প্রথা নেই। তবে বুদ্ধ পূর্ণিমায় মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবসে ও কালীপুজোয় এই ২ দিন মহাসমারহে মায়ের পুজো হয়। এছাড়া প্রত্যহ সকাল সাড়ে ৬টা, দুপুর ২টো ও রাত সাড়ে ৮ টায় মায়ের পুজো ও আরতি করা হয়। রাতের আরতির পর প্রসাদ বিতরণ হয়। মায়ের নৈবেদ্যতে প্রতিদিন থাকে মাছ, ভাত, বিভিন্ন রকম ফল ও মিষ্টি। ভক্তদের দেওয়া প্রণামিতে মায়ের সেবা হয়। নিত্যপুজোর পাশাপাশি বুদ্ধ পূর্ণিমায় প্রতিষ্ঠা দিবসে এবং কালীপুজোর দিন বিশেষ হয় উৎসব। স্থানীয়দের মতে, হাজার-হাত কালী খুবই জাগ্রত, ভক্তদের মনবাঞ্ছা পূরণ করেন মা কালী। প্রতিদিন বিকেলে ও রাতে ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ দেওয়া হয়।
শোনা যায়, একদা মন্দির নাকি ভেঙেও দেওয়া হয়েছিল। ফের মন্দির গড়ে তোলেন আশুতোষ। পাকা মন্দির এবং সিংহের উপরে ডান পা তুলে দাঁড়িয়ে বিশালাকার নীলগাত্রবর্ণা দেবীর প্রতিমাও সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হয়। এখনও বংশানুক্রম আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের সদস্যরাই এই মন্দিরের পৌরহিত্যের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এলাকাবাসীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ও জাগ্রত এই হাজার হাত কালী মায়ের মন্দির। সারা রাজ্য এমনকি সারাদেশ থেকে প্রতিবছর বহু ভক্তদের সমাগম হয় এই মন্দিরে। কথিত আছে, ১৮৭০ সালে শিবপুরের ওলাবিবিতলার মুখোপাধ্যায় বাড়ির ছেলে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মা চন্ডীর স্বপ্নাদেশে কালির ওই রূপটি দেখতে পান।কাত্যায়নী, মহামায়ার পরেই অসুর নিধন করতে আসেন হাজার হাত রূপী মা কালী। চণ্ডীপুরাণের ২২তম অধ্যায়ে কালীর এই রূপের কথা উল্লেখ রয়েছে। ১৮৭০ সালে এই কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তখন থেকেই কালীপুজো হয়েছে আসছে শিবপুরের ওলাবিবিতলায়। সেই সময় মন্দিরের আশেপাশের এলাকা জঙ্গলপূর্ণ থাকায় এই মন্দিরে পুজো দিয়ে যেতেন ডাকাত ও দস্যুরা।
প্রথমদিকে মূর্তিটি ছিল মাটির, পিছনের চালায় হাজারটি হাত আঁকা ছিল। পরবর্তীকালে চুন, সিমেন্ট, বালি, ইঁট ও আমেরিকান প্লাস্টার সহযোগে গঠিত হয় এই বিশাল আকার হাজার হাত কালীর মূর্তি। প্রতিমার মতই মায়ের হাতগুলিও তৈরি ওই একই উপাদান সহযোগে। তবে কথিত আছে, দেবী কালীর হাজার হাত নাকি দেখা যায় না। এক ব্যক্তি চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই মন্দিরের দেবী খুব জাগ্রত। ভক্তিভরে কিছু চাইলে মা কালী তাঁদের ফিরিয়ে দেন না। শতাধিক বছর ধরে এখানে অবস্থান করছেন হাজার হাতের কালী। এই মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট হল, শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষে দেবী তামিল ভোগ খান। হাওড়ার আমিষ ভোগ ভুলে সেদিন দেবী টক ভাত, ঝাল ভাত, মিষ্টি ভাত, সম্বর, বড়া, দই ভাত, ঝুড়ি ভাজা, মুরুব্বুতে মজেন। পাশাপাশি শ্রাবণ মাসের শুক্রবারে বহু দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তদেরও সমাগম হয় এই হাজার হাত কালী মন্দিরে। শিবপুর অঞ্চলের ওলাবিবিতলা থেকে একটু এগোলেই দেখা মিলবে এই হাজার হাত কালী মায়ের মন্দিরের। দেবীর নামেই জায়গার নাম হয়ে গিয়েছে হাজার হাত কালীতলা। লোকমুখে তা উচ্চারণ ভেদে হাজারাত কালীতলা নামেও পরিচিতি পেয়েছে।