হাঁস, মুরগী, পাঁঠা, মোষ, ডাকাতকালীর জন্য নর -বলি দেওয়া 'হাড়িকাঠ' নিয়ে ভাবলে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা রক্তস্রোত বয়ে যায়? তাহলে জেনে নিন এই 'গল্প' নয়, সত্যি কথা। ইতিহাসের সেই সত্যি কথাই আপনার সামনে 'খাঁড়া' করবে 'গিলোটিন' যন্ত্রকে, যাকে বাংলার 'হাড়িকাঠ'-এর এক উন্নত সংস্করণ বলা যেতে পারে, যার ব্যবহারিক প্রয়োগ মানবিকতার উর্ধ্বে, নির্মমতার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। তবুও তার ঐতিহাসিক উপস্থিতি আজও খুঁজে বেড়ায় মানুষ।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিখ্যাত কারিগররা বানিয়েছেন বা বানিয়ে চলেছেন আশ্চর্য, নিঁখু্ত তাক লাগিয়ে দেওয়া সব যন্ত্রপাতি। মানুষের জীবনযাপন, মনোরঞ্জনের সুবিধার্থে আবিষ্কৃত হয়েছে নানাধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্র, বাদ্য যন্ত্র, -বিচিত্র গুরুত্বপূর্ন সব যন্ত্র। যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রীর সম্পর্ক প্রাথমিকভাবে 'প্রয়োজনের', কিন্তু যিনি বানাচ্ছেন অর্থাৎ আবিষ্কর্তা/কারিগর/শিল্পী, তাঁর সঙ্গে কিন্তু যা বানানো হচ্ছে তার সম্পর্ক সাত্ত্বিক অর্থাৎ আত্মবোধের। নিজের ভাবনার সূক্ষ্মতা দিয়েই শিল্পী বানান তাঁর উৎকৃষ্ট শিল্প-নিদর্শন, কিন্তু তা যদি হয় ঘাড় থেকে গর্দান আলাদা করার যন্ত্র?
হ্যাঁ, কোন মানুষ দোষী সাব্যস্ত হলে তার মুণ্ডচ্ছেদ করাই ছিল 'গিলোটিন'-এর কাজ। ডা. জোশেফ ইগনেস গিলোটিন, সেই মারণ যন্ত্রের শিল্পী-প্রবর্তক। কতটা 'স্মুদলি' মৃত্যুদণ্ড দিলে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে এই ভাবনা থেকেই ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব চলাকালীন এই যন্ত্রের প্রবর্তন করেন তিনি।
প্রায় দু'শ তেইশ বছর আগে অর্থাৎ সতেরোশ' ঊননব্বই-এর ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গে বন্দুকের আওয়াজের মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সমাজের সর্বস্তরে সমতার দাবী ছিল এই ফরাসি বিপ্লবের একটি অংশ। আর তার রেশ ধরেই অপরাধীদের জন্য মানবিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দাবী জানানো হয়। এসবের মধ্যেই ১৭৮৯ সালে ডাক্তার জোসেফ ইগ্নেস গিলোটিন জাতীয় পরিষদ বা বিধানসভার কাছে ৬টি প্রবন্ধ পেশ করেন। মৃত্যুদণ্ডকে ঢেলে সাজানোর বিশদ বিবরণ ছিল এই প্রবন্ধগুলোতে।
ডাঃ গিলোটিন ও তার সহকর্মীরা এসময় হালিফ্যক্স গিব্বেট ও স্কটিশ মেইডেন নামের পূর্ব প্রবর্তিত দুটি শিরচ্ছেদ যন্ত্র থেকে নতুন ও উন্নত একটি যন্ত্র তৈরির অনুপ্রেরণা পান। পূর্বের এ দুটি যন্ত্রই ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রিটেনে প্রচলিত ছিল। তবে এই যন্ত্রগুলোতে বিশাল আকারের কুড়ালের মাথা ব্যবহার হতো। ভোঁতা এই অস্ত্রটি দিয়ে খুব জোরে আঘাত করে শিরচ্ছেদ করা হতো যা মোটেই সুবিধের ছিল না। এভাবে কয়েক মাস যাবার পরে ল্যাক্যুইয়ান্তে নামের স্ট্রাসবার্গ ক্রিমিনাল কোর্টের একজন অফিসার একটি যন্ত্রের নকশা তৈরি করেন যেটিই আসলে বিখ্যাত গিলোটিনের প্রকৃত রূপ। তার এই নকশা কমিটির সবারই খুব পছন্দ হয় ফলে তারা এটির একটি আনুমানিক ক্ষুদ্র সংস্করণ বা প্রোটোটাইপ বানানোর জন্য টোবিয়াস স্কিমিড নামের এক জার্মান প্রকৌশলীকে নিয়োগ করেন।
টোবিয়াস সেই নকশায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনে আরও উন্নত রূপে একটি যন্ত্র তৈরী করেন। তিনি সেই যন্ত্রে ৪৫ ডিগ্রী কোণে একটি লম্বা ব্লেড যুক্ত করেন। বানানোর পর অ্যান্টনি লুইসের নামে যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয় ‘লুইসেট্টে’। পরে তার নাম বদলে যে মানুষটি এই যন্ত্রের প্রথম প্রস্তাবনা রেখেছিলেন সেই ডাঃ গিলোটিনের নামেই যন্ত্রটির নাম রাখা হয় 'গিলোটিন'।
ডা. জোশেফ ইগনেস ছিলেন একজন সুচিকিৎসক এবং ১৭৮৯-তে ভার্সাইতে 'এতা জেলেরা' অর্থাৎ 'জাতীয় মন্ত্রিসভা'য় নির্বাচিত সদস্য হন। শোনা যায়, দোষীদের যতটা সম্ভব যন্ত্রণাহীন মৃত্যু দেওয়ার জন্যই তিনি এই শিরশ্চেদনের অভিনব যন্ত্রটির কথা ভাবেন। এ জন্য তিনি বিস্ত্রে (BICETRE) হাসপাতালে দিনের পর দিন একাধিক শবদেহের উপর এই যন্ত্রের কার্যকরিতা পরীক্ষা করেন ও সন্দেহ দূর হলে হলে তাঁর দেশে তিনি এই যন্ত্রে দোষীদের মুণ্ডচ্ছেদের আইনটিও পাশ করিয়ে নেন। এর পরেই ১৭৯২ সালের ২৫ এপ্রিল ডি গ্রিভ শহরের উন্মুক্ত প্রান্তরে এই যন্ত্রটি প্রতিস্থাপন করা হয় এবং সর্বপ্রথম একজন 'হাইওয়ে ম্যান'-এর মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। তার দু'বছর পর ১৭৯১-তে সে দেশের রাজা ষোড়শ লুই ছদ্মবেশে ভার্নেতে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন। তার ঠিক এক বছর সাত মাসের মাথায় রাজাকেই ধরে গিলোটিনে চালান করে দেওয়া হয়। মাটিতে গড়িয়ে পড়ে রাজার মুণ্ড। ফরাসি বিপ্লবের কাহিনী থেকে গিলোটিনকে কিছুতেই আলাদা করা যায় না, কত তাবড় তাবড় বিপ্লবী, কত মানুষের মুণ্ডচ্ছেদ এভাবে হয়েছে তার হিসেব নেই। একটা কাঠের সুদৃশ্য বেঞ্চের ওপর উপুড় করে শুইয়ে গোল করে কাটা হাড়িকাঠের মধ্যে আটকে, মাথার ওপর উঁচু থেকে একটা ভারি তির্যক ধারালো ছুরির পাত ছেড়ে দেওয়া হত আর তাতেই 'ঘ্যাচাং ফু'।
তবে ডাঃ গিলোটিনের নাম অনুসারে 'গিলোটিন' যন্ত্রের নামাঙ্করণ হলেও শব্দটির অবশ্য অন্য একটি অর্থও রয়েছে। ইংল্যান্ডে পার্লামেন্ট বিতর্কের সমাপ্তিকেও গিলোটিন বলা হয়। ফ্রান্সে গিলোটিনের শেষ প্রয়োগ হয় ১৯৭৭ সালে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যেই গিলোটিনে মৃত্যুর হার কমে আসে। ১৯৮১ সালে ফ্রান্সে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ হয় এবং সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় 'গিলোটিন'ব্যবস্থা। মজার বিষয় হল এখনও ব্যবহৃত হয় গিলোটিন যন্ত্র, অবাক হলেন? হ্যাঁ, এখনও গিলোটিন ব্যবহৃত হয় ছাঁটাইয়ের কাজে, তবে মুণ্ডু নয়, কাগজ।