বেহালার সোনার দুর্গা মন্দির

সেকালের বঙ্গের অন্যতম প্রাচীন জনপদ হল বেহালা। তখনও কলকাতা গড়ে ওঠেনি, তার থেকেই বেহালা ছিল সমৃদ্ধি অঞ্চল। বেহালার ব্রাহ্ম সমাজ রোডের মুখার্জী বাড়িতে রয়েছে সোনার দুর্গা। প্রতি বছর জাঁকজমকপূর্নভাবে এখানে দুর্গাপুজো হয়। ব্রাহ্মসমাজ রোডের মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গা মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। মুখোপাধ্যায় বংশের পূর্বপুরুষ দ্বাদশ শতকে কনৌজ থেকে বাংলায় চলে আসেন। কবি কৃত্তিবাস ওঝা এই পরিবারের একজন পূর্বপুরুষ। মহাকবি কৃত্তিবাস ওঝা প্রণীত রামায়ণের বাংলা অনুবাদ শ্রী রাম পাঁচালীতে রামচন্দ্র কর্তৃক শারদীয়া দুর্গোৎসবের কথা উল্লেখ রয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণে কিন্তু তা নেই। মুখোপাধ্যায় বংশের ২৪তম পুরুষ জগতরাম মুখোপাধ্যায়ের আমলে তাদের বাড়িতে দুর্গা পুজোর প্রচলন হয়।
 
জগতরাম বেহালায় বসবাস করতে আরম্ভ করেন। সেই সময় তাঁর মেয়ে জগত্তারিণী একদা দুর্গা পুজোর অষ্টমীর দিন বাবার কাছে দুর্গাপুজো করার আবদার করে বসেন। কিন্তু অষ্টমীর দিন তো আর নতুন করে প্রতিমা এনে পুজো করা সম্ভব নয়, তাই সেবার ঘটেই পুজো সারা হয়েছিল। তারপর থেকে দেবী দুর্গার পটেও বেশ কিছুকাল দুর্গা পুজো করেছে মুখোপাধ্যায় পরিবার। তারপর জগতরামের ছেলে ভবানীশঙ্করের আমলে সোনার দুর্গামূর্তি স্থাপিত হয়।
 
অন্য এক কিংবদন্তি অনুযায়ী, যশোরের ঝিকরগাছা থেকে বেহালায় এসে থাকতে শুরু করেছিলেন জগৎরাম মুখোপাধ্যায়। তিনিই মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গা পুজোর প্রতিষ্ঠাতা। জগৎরামের জীবনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। তখন যশোরে তার ভরা সংসার। মাত্র ৩০ বছর বয়সে হয়ত হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে তার হঠাৎ করেই মৃত্যু হয়। কিন্তু শ্মশানে হঠাৎ করেই প্রাণ ফিরে পান তিনি। মৃত্যুর পর আবার বেঁচে ফেরার জন্য, তৎকালীন সমাজ তাকে মেনে নেয়নি। অগত্যা তিনি এপার বাংলায় চলে আসেন। বেহালা চত্বরে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি অযোধ্যা হালদারের মেয়েকে বিয়ে করেন নতুন সংসার শুরু করেন।
 
মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজোর শুরু হয় ১৭৭০ নাগাদ। জগৎরামের চার ছেলে ও একমাত্র কন্যা জগত্তারিণী, প্রত্যেকবারের মতো সে'বছরও তারা মামার বাড়ির দূর্গাপুজোয় গিয়েছে। কিন্তু জগৎরামের মেয়ের মনে হল, তাকে যেন কেউ অবহেলা করছে। অভিমান নিয়ে অষ্টমীর দিন বাড়ি ফিরে এলো সে। বাবাকে জানালো সেও বাড়িতে দূর্গাপুজো করতে চায়, আর সেটা সেই বছরেই। মেয়ের ইচ্ছায় পরের দিন অর্থাৎ নবমীতেই ঘটে-পটে পুজো করলেন জগৎরাম। পুজোর সেই শুরু। তখন ঘটে-পটে দুর্গাপুজো চলত। কিন্তু সোনার মূর্তির গল্প আবার আলাদা। জগৎরামের নাতি যদুনাথ মুখোপাধ্যায় কাজের জন্যে ঢাকায় থাকতেন। সেখানে থাকাকালীন ঢাকেশ্বরীর মূর্তি দেখে তিনি ঠিক করলেন, কলকাতার বাড়িতে সেই আদলে সোনার দূর্গা মূর্তি গড়বেন। কিন্তু শুধু সোনার তৈরি প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। তাই ১৮৬৯ সালে বেহালার বাড়িতে অষ্টধাতু সংযোগে মাতৃমূর্তি স্থাপিত হল। তারপর থেকেই, সোনার প্রতিমাই প্রতি বছর পূজিত হচ্ছে। 
 
শারদীয়া দুর্গা পুজোই এই মন্দিরের মূল উৎসব। পঞ্চমীর দিন দেবীকে এখানে রাজবেশে সাজানো হয়, যা কোজাগরী পূর্ণিমা অর্থাৎ লক্ষ্মীপুজো অবধি থাকে। ষষ্ঠীতে বোধন কল্পারম্ভ শুরু করে চারদিন ষোড়শ উপচারে পুজো হয়। এখানকার দেবীমূর্তির বৈশিষ্ট্য হল, এখানে দেবী জয়া-বিজয়া বেষ্টিতা। অষ্টমীর দিন এখানে কুমারী পুজো হয় না, বদলে সাধবা পুজো করা হয়। নবমীর দিন ছাগ বলি দেওয়া হয়। দশমীর দিন বিশেষ শঙ্খ দিয়ে দেবীকে প্রদক্ষিণ করা হয়। দশমীর দিন কেবলমাত্র ঘট আর নবপত্রিকার বিসর্জন হয়।
 
​এই বাড়ির দুর্গাপুজোয় ভাতে ভবানী ও সন্দেশের শিবু উৎসবের স্মৃতি মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এই পরিবারেরই পুরুষ ভবানী মুখোপাধ্যায়ের আমলে এখানে দেবীর অর্ঘ্যে ভাতের পাহাড় এবং আরেক পুরুষ শিবু মুখোপাধ্যায়ের আমলে এখানে সন্দেশের পাহাড় তৈরি হত। এখানে পুজো হয় তান্ত্রিক মতে, দেবীর পুজোয় বলি প্রথার প্রচলন রয়েছে। পশুবলির সঙ্গে সঙ্গে চালকুমড়ো ও আখ বলিও হয়। মুখোপাধ্যায় বাড়ির ভোগের বিশেষত্ব হল, প্রতিপদ থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত প্রতিদিনই দেবী ফল-মিষ্টি সহযোগে দেবীর ভোগ নিবেদন করা হয়। এই বাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পোড়া মাছ ভোগ। সকালে হয় খিচুড়ি ভোগ, দুপুরে সাদা ভাত, ডাল, তরকারি এবং অবশ্যই মাছপোড়া, ল্যাটা, সিঙ্গি, মাগুর বা অন্য কোনও মাছ পোড়া দেওয়া হয়। বিজয়ার দিন পান্তা-ভোগ দেওয়া হয়, যা নবমীর রাতে ভাতে জল ঢেলে বানানো হয়। এর সাথে কচু-ঘন্ট, মাছপোড়া আর চালতার অম্বল দেওয়া হয়। মা যেহেতু কৈলাসে ফিরবেন, আর কৈলাসের পথ অনেকটা লম্বা পথ, তাই সেই যাওয়ার পথে খাবার জন্য কন্যারূপী মাকে দই, খই, মুড়কি ও চিড়ে দেওয়া হয়। বিসর্জনের অনুষ্ঠানে থেঁতো পান খাওয়ানো হয়।​
 
এই বাড়ির পুজোয় সন্ধিপুজো হয় না। যার নেপথ্যে রয়েছে  অদ্ভুত এক কাহিনী। অনেক বছর আগে, সন্ধিপুজোর পূর্বে পুজো প্রাঙ্গণে একটি ছোট্ট মেয়ে লাল শাড়ি পরে খেলছিল। কিন্তু পুজোর পর তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন অদ্ভুত ভাবে সবাই দেখতে পায়, দুর্গা মূর্তির ঠোঁটের কোণে এক টুকরো লাল কাপড়, যা ছিল সেই বালিকার শাড়ির অংশ। এই অলৌকিক ঘটনার পর থেকেই এ বাড়ির সন্ধিপুজো বন্ধ হয়ে যায়। নবমীর দিন এক বিশেষ পুজো হয়, যার নাম সধবা পুজো। পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠা সধবার পুজো করা হয়। এক বিশেষ স্তোত্র বটুক ভৈরব, দশমীর বিদায় সন্ধ্যায় পাঠ করা হয়। এরপরে পারিবারিক পুকুরে নবপত্রিকা ও ঘট বিসর্জন দিয়ে, বাৎসরিক দুর্গোৎসব সমাপ্ত হয়।
 
এই মন্দিরে কালীপুজোও করা হয়। কার্তিক অমাবস্যায় অর্থাৎ কালীপুজোর দিন সন্ধ্যা নামলে দুর্গামূর্তি সরিয়ে পার্শ্বস্থ শিব মন্দিরে রাখা হয়, আর দুর্গা সিংহাসনে এলকেশী কালীমূর্তি স্থাপন করে পুজো করা হয়। সেদিন রাতেই পুজো পর দেবী কালিকার মূর্তি বিসর্জন দিয়ে দেওয়া হয়। পরের দিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই দেবী দুর্গা তাঁর আসনে ফিরে আসেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...