বঙ্গের দেবী কালী নানাবিধ রূপে পূজিতা হন। তার মধ্যে অন্যতম হল শ্যামাকালী। কিন্তু শ্যামরায় কালী কী? শ্যামরায় কালী নামে এক কালী রয়েছেন বাংলায়। মুর্শিদাবাদের কান্দির অন্যতম প্রাচীন গ্রাম হল গোকর্ণ, গ্রামটিকে কালী গ্রাম বলা যেতে পারে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই শক্তি আরাধনার জন্য সুপ্রসিদ্ধ গ্রামটি। এখানেই রয়েছে শ্যামরায় কালী মন্দির। শ্যামরায় কালী খুবই জাগ্রত।
গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ থেকে কয়েক কিলোমিটার দুরে অবস্থিত গোকর্ণ, কালীপুজোর রাতে এখানে মোট ৪৮টি কালীপুজো হয়। সেই কারণেই গ্রামের নাম কালী গ্রাম। শোনা যায়, এই গ্রামে রাজা শশাঙ্কের গোশালা ছিল, তাই গ্রামের নাম গোকর্ণ। এই গ্রামে রয়েছেন শিব, রাজা গোকর্ণেশ্বর শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পাল বংশের রাজত্বকালে ধর্মপালের আমলে গোকর্ণ গ্রামকে একটি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সামন্ত রাজ্য বলে বর্ণনা করেছেন। ১৯৯৩ সালের ঘূর্ণিঝড়ে গ্রামটি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখন কালীপুজোকে ঘিরেই গ্রামটি বিখ্যাত। একদা গ্রামে ৮০-৯০টি কালীপুজো হত। যদিও এখন সংখ্যাটা কমে গিয়েছে। তবে দুর্গাপুজোর চেয়েও কালীপুজোতে গ্রামটি উৎসব মুখরিত হয় বেশি।
গ্রামের প্রাচীন পুজো হল শ্যামরায় কালী, এছাড়াও রয়েছে বড়িজ্যা কালী, গঙ্গাময়ী কালী, কোটাল কালী, বড়রায় কালী, ছোট কালীবাড়ির পুজো, বেনেকালী। বড়িজ্যা কালী নিয়ে একটি জনশ্রুতি রয়েছে, গ্রামের সব পুজো গভীর রাতে শুরু হলেও বড়িজ্যা কালীর পুজো শুরু হয় সন্ধ্যায়। শোনা যায়, একবার পুজোর সময় গ্রামের একটি শিশুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, গোটা রাত খুঁজেও শিশুটিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরদিন সকালে বড়িজ্যা কালীর মুখে ওই শিশুর পরনের কাপড়ের টুকরো দেখা যায়। তারপর থেকেই বড়িজ্যা কালীর পুজো শুরু হয় সন্ধ্যায় আর সূর্য ওঠার আগেই দেবীর নিরঞ্জন হয়। শ্যামরায় কালী, বড় রায় কালী, ছোট কালীবাড়ির কালী, গঙ্গাময়ী, বেনে কালী কৌলিক পুজো বলে পরিচিত। কালীপুজোকে ঘিরে গোকর্ণে বিশাল মেলা বসে।
প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম বড়রায়,শ্যামরায়ের পুজো। স্থানীয়রা বলেন বড়রায় কালী পুজোর বয়স অনুমানিক এক হাজার বছরেরও বেশি। মন্দিরের বেদিতে বিরাজ করেন দেবী। দেবীর সামনে পুরোহিতদের বসার জন্য রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। দেবীর নিত্যভোগ হয়। কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যায় দেবী আরাধনা হয় ধুমধাম করে। প্রতি শনি, মঙ্গলবারে মন্দিরে ভিড় উপচে পড়ে।
শ্যামরায় কালীর পুজোর প্রচলন করেছিলেন জমিদার হটেশ্বর রায়। তবে শ্মশান কালী বলে তিনি গ্রামের বাইরেই দেবীর প্রতিষ্ঠা করেন। জমিদারের নামানুসারে কালীর নাম হয়, হট্টরায় কালী। পরবর্তীতে রায় বংশের এক সাধকের নামানুসারে কালীর নাম হয় শ্যামরায় কালী। আগে শ্মশানে মায়ের আসনে রত্নবেদির ওপর পুজো হত। কালী প্রতিমা গ্রামের বাইরে থাকায় রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে নানান রকম অসুবিধা দেখা দেয়। হট্টেশ্বর রায়ের বংশের উত্তরপুরুষ শ্যামচরণ রায় স্বপ্নাদেশ পেয়ে গোকর্ণের পুকুরপাড়ের শ্মশান বেদী থেকে পাঁচবাড়ি পাড়াতে কালীকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চমুণ্ডি আসনে প্রতিষ্ঠিত এই শ্মশান কালীর পুজো হয় তান্ত্রিক মতে। আনুমানিক দুশো বছর আগে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল।
আবার আরেকটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, দেবীকে শ্মশান থেকে তুলে এনে নিজের বাড়িতে স্থাপন করেছিলেন শ্যামাচরণ রায়। তাঁর নামেই বিগ্রহের নামকরণ হয় শ্যাম রায় কালী। অত্যন্ত জাগ্রত এখানকার দেবী কালিকা। দেবী মনস্কামনা পূরণ করেন বলেই বিশ্বাস করেন ভক্তরা। শুধু তাই নয়, আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করেন এই দেবী। স্বপ্নাদেশ পেয়েই ওই বিগ্রহ বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্যামাচরণ। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর-কান্দি রাজ্য সড়কের পাশে এই মন্দির। যাতায়াতের জন্য বাস রয়েছে। গোকর্ণ হাসপাতাল বা বায়েনপাড়া স্টপেজে বাস থেকে নেমে মন্দিরে যাওয়ার জন্য টোটো পাওয়া যায়। আজও প্রতি বছর যাবতীয় রীতি মেনেই গোকর্ণের মন্দিরে কালী পুজো হয়। ভক্তদের বক্তব্য, এখানে মায়ের কাছে শুদ্ধ মনে প্রার্থনা করলেই ফল মেলে।
জানা যায়, আজ থেকে তিন-চারশো বছর আগে গোকর্ণ এলাকায় একটি শ্মশান ছিল। সেখানে জনৈক হটেশ্বর রায়, অবস্থাপন্ন এক গৃহস্থ শ্মশানকালীর মূর্তি স্থাপন করে পুজো শুরু করেছিলেন। স্থানীয় লোকজন এই কালীকে হাটুরায় কালী বলে ডাকতে শুরু করে। শ্মশানে একটি রত্ন বেদীতে দেবীর পুজো হত। কিন্তু এরপরই শ্যামাচরণ রায় নামক অন্য এক ব্যক্তি মা কালীর স্বপ্নাদেশ পান। দেবী তাঁকে হাটুরায় কালীকে নিজ গৃহে প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শ্যামাচরণ নির্দেশ পালন করেন। কালে কালে সেই কালীই শ্যামরায় কালী নামে পরিচিতি লাভ করে।