আজ কালী কথায় গড়িয়ার এক কালীর কথা। গঙ্গার প্রধান শাখা যা আদি গঙ্গা নামে পরিচিত, তা এই অঞ্চলের ওপর দিয়েই বয়ে যেত। ১৫১০ সালে শ্রীচৈতন্যদেব শান্তিপুর থেকে যখন নীলাচলের দিকে যাত্রা করেছিলেন, সে'সময় আদি গঙ্গার তীরে, গড়িয়া ও পদ্মশ্রী সংলগ্ন গঙ্গার ঘাটে স্নান করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। গঙ্গার ঘাটেই কাছে ছিল মহাশ্মশান। আবুল ফজলের আইন আকবরীতে গড়িয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এখানেই রয়েছে জোড়া মন্দির।
শোনা যায়, মন্দির দু’টি তৈরি করান শ্রীমন্ত সওদাগর। জোড়ামন্দিরের একটিতে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে কষ্টিপাথরের কালী, অন্যটিতে শিব। মন্দিরের গায়ে পাথরের ফলকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লেখা আছে শ্রীমন্ত সওদাগরের নাম। বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই মন্দির। সিঁড়ির ছয় ধাপ পেরিয়ে ফুট পাঁচেক উঁচু বেদির উপরে পাশাপাশি দু’টি মন্দির অবস্থিত। উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট।
মুকন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গলে বৈষ্ণব ঘাটার নাম রয়েছে, উল্লেখ রয়েছে শ্রীমন্ত সওদাগরের নামও। বণিক ধনপতির পুত্র শ্রীমন্ত যাচ্ছেন বাণিজ্য যাত্রায়। ভাগীরথী হয়ে সিংহলে পৌঁছবে তাঁর বাণিজ্য তরী। মঙ্গলকাব্যে রয়েছে -
“নাচনগাছা বৈষ্ণবঘাটা বামদিকে থুইয়া।
দক্ষিণেতে বারাসত গ্ৰাম এড়িইয়া
ডাইনে অনেক গ্ৰাম রাখে সাধুবালা
ছত্রভোগে উত্তরিল অবসানবেলা।।”
মধ্যযুগের আগে থেকে ভাগীরথীর এই জলপথ ধরেই বাণিজ্য তরী নিয়ে তাম্রলিপ্ত বন্দর হয়ে বাংলার বণিকরা জাভা, সুমাত্রা, সিংহলে বাণিজ্য করতে যেত। মঙ্গলকাব্যের শ্রীমন্ত সওদাগর আদি গঙ্গা দিয়েই বাণিজ্যে যেতেন। এখন যেখানে গড়িয়া, সেখান দিয়েই বয়ে যেত সেকালের আদি গঙ্গা। আজ গঙ্গা মজে গিয়েছে। ভাগীরথীর জলপথ দিয়েই সোজা সাগরে পৌঁছে যেতেন সে সময়ের বণিকরা।
জনশ্রুতি রয়েছে, শ্রীমন্ত সওদাগর গড়িয়ায় জোড়া শিবমন্দির স্থাপন করেছিলেন। আজও সেই জোড়া শিবমন্দির রয়েছে গড়িয়ায়। গড়িয়া মহাশ্মশানের ভিতরে রয়েছে মন্দির দু’টি। একটি মন্দিরে রয়েছেন শিব। অন্যটিতে কালী। স্থানীয়দের বিশ্বাস, শ্মশান কালী অত্যন্ত জাগ্রত। ভক্তরা দূর-দূরান্ত থেকে পুজো দিতে আসেন এখানে। মন্দির দুটির অবস্থা জরাজীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে সংস্কার চলছে।
শোনা যায়, শ্রীমন্ত সওদাগর এখানে দুটি শিব মন্দির তৈরি করেছিলেন। তবে কালী মন্দির গড়ল কে? মা কালীর প্রতিষ্ঠাতাই বা কে? প্রচলিত রয়েছে এক কাহিনি। শোনা যায়, এই মন্দির থেকে কষ্টি পাথরের শিব চুরি গিয়েছিল। তখন এলাকাজুড়ে জঙ্গল ছিল, চোরের উপদ্রবও ছিল। বহু খোঁজার পর যাদবপুরের কাছে, চুরি যাওয়ার শিবের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু শিবলিঙ্গ ফিরিয়ে আনা যায়নি। ওখানেই কোথাও আজও সেই শিবলিঙ্গ রাখা রয়েছে বলেই জানা যায়। তারপর থেকে জোড়া মন্দিরের একটি মন্দির ফাঁকাই থাকত। এক তান্ত্রিক সেখানে কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
পাঁচপোতায় কৃষ্ণচন্দ্র সরকার নামের এক তান্ত্রিক থাকতেন। তিনি একদিন এসে বললেন, তিনি ফাঁকা পড়ে থাকা মন্দিরটিতে কালী মূর্তি স্থাপন করে পুজো করতে চান। সকলে সম্মত দিলে তিনি তান্ত্রিক মতে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১২৫ বছর আগে কালী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তান্ত্রিক নিজেই মূর্তি গড়তেন।
আবার প্রতিবছর ভাদ্র মাসের অমাবস্যা তিথিতে পুরনো মূর্তি ভেঙে, নতুন করে মূর্তি তৈরি করতেন। এভাবেই শিব মন্দিরে মা কালীর আগমন ঘটল। সেই তান্ত্রিকের মৃত্যুর পর একই উচ্চতার কষ্টি পাথরের কালী মূর্তি এখানে প্রতিষ্টা করা হয়েছিল। সেই মূর্তিই আজও পূজিতা হচ্ছেন।
মূর্তিটি আশ্চর্য, দেবী কালিকার মাথায় খোঁপা। এক হাতে কাটা হাত, আর অন্য আরেকটি হাতে বাটি। মা শ্যামাবর্ণা। মায়ের চোখ অপরূপ শান্তি রয়েছে। কালী পুজোর সময় অর্থাৎ কার্তিক অমাবস্যায় আজও এখানে দূরদূরান্ত থেকে তান্ত্রিকরা এসে ভিড় করেন। ভক্তদের বিশ্বাস, এখানে মানত করলে মনবাসনা পূর্ণ হয়।