আজ কালী কথায় ফৌজদারি কালীর কথা। কলকাতায় এক শিব আছেন তাঁর নাম হাইকোর্টেশ্বর আবার মদনমোহনের মামলার কথা আমাদের সক্কলের জানা; বর্ধমানে কোর্ট-কাছারি জড়িয়ে গিয়েছে দেবী কালিকার সঙ্গে। তিনি কেবল দেবী নন, দেবী কালিকা খোদ ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রতিবাদ। আজও দেবীর পুজো হয়। মানুষের বিশ্বাস যেকোনও আইনি সমস্যায় জড়িয়ে গেলে মা-কে ডাকলে মনোস্কামনা পূর্ণ হবে। মামলার জাল থেকে রেহাই মিলবে। আজও ফৌজদারি কালীর বিসর্জনের মিছিলে হাঁটাকে পুণ্য বলে মনে করেন বর্ধমানবাসী। ভক্তদের কাঁধে চড়ে দেবী যান বিসর্জনের পথে। বর্ধমানের খোসবাগান এলাকায় রয়েছে এই কালীর মন্দির। এই কালী পুজোর বয়স প্রায় একশো বছর। কার্তিক অমাবস্যায় দেবীর পুজো হয়। দেবী চতুর্ভুজা, পদতলে থাকেন মহাদেব।
একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, ১৯২৫ সালের শুরু হয়েছিল দেবীর পুজো। তৎকালীন মুসলিম লিগ সরকার রাজ্যে কালী প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল বাংলা, বাদ যায়নি বর্ধমান। শ্রীকুমার মিত্র, টোগো ওরফে অজিত সরকার-সহ পাঁচ সমাজসেবী সরকারের ফরমানের প্রতিবাদের এক উপায় বের করেন। তাঁরা কালীপুজোর সময় শহরের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলতে থাকেন, কেউ যদি তাঁদের একটি প্রতিমা দেন, তাহলে সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পুজো করবেন এবং সেই প্রতিমা নিয়ে শোভযাত্রা বের করবেন। ব্রিটিশ পুলিশের ভয়ে বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে কালীপুজো করলেও, প্রতিমা দিতে সাহস পাননি। সাহস দেখিয়েছিলেন তৎকালীন রাজরাজেশ্বর শিবতলা লেনের বাগদিরা। তাঁরা দেবীকে শ্রীকুমার মিত্রদের হাতে তুলে দেন। সেই প্রতিমা নিয়ে বিসর্জনের শোভযাত্রা করেন প্রতিবাদকারীরা। শহরজুড়ে পরিক্রমা করার পর রাজবাড়ির উত্তর ফটকের কাছে ভেড়িখানায় পুলিশ শোভযাত্রার গতি রোধ করে। উদ্যোগক্তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এক মাস ধরে প্রতিমা পড়ে থাকে ভেড়িখানার পুকুর পাড়ে। প্রতিবাদে সমাজসেবীরা বর্ধমান জজ কোর্ট ও পরে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। শেষে মামলায় জেতেন। এক মাস পরে শহর ঘুরে ঢাক ঢোল বাজিয়ে গুরুদাসী পাড়ের পুকুরে প্রতিমার নিরঞ্জন হয়। কেউ কেউ বলেন, খোদ দেবী কালী নাকি মামলায় সাক্ষী দিতে গিয়েছিলেন। যেহেতু মামলা করেই দেবীর বিসর্জনের অনুমতি আদায় করা হয়েছিল, তাই দেবী ফৌজদারি কালী নামে জনপ্রিয়তা পায়।
তবে পুজোকে কেন্দ্র করে আরও একটি কিংবদন্তি রয়েছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, দেবীর মাহাত্ম্য ১৯৫২ সাল থেকে ছড়িয়ে পড়ে। সে'সময় এই দেবী বাগদি পাড়ার কালী নামে পূজিতা হতেন। সেই সময় শোভাযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে এলাকার কয়েকজন কালী প্রতিমা নিয়ে বিসর্জনের সময় শোভাযাত্রা বের করে। কিছুদূর যাওয়ার পর পুলিশ তাদের আটকায়। প্রায় ২০ জনকে গ্রেপ্তার করে। কালী প্রতিমা ওই জায়গাতেই পড়ে থাকে। জামিনের আবেদন চেয়ে মামলা শুরু হয় হাইকোর্টে। আইনজীবী বিনা পারিশ্রমিকে মামলা চালান। এরপর হাইকোর্ট জামিন মঞ্জুর করে, পাশাপাশি শোভাযাত্রার অনুমতিও দেয়। মামলা জিততেই দেবীকে নিয়ে সারা বর্ধমানে বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। দিনটা ছিল ভাইফোঁটার পরের দিন। মানুষের বিশ্বাস দেবীর আশীর্বাদেই মামলায় জয় মিলেছিলে। তারপরই দেবীর মাহাত্ম্য চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। তখন থেকে দেবী ফৌজদারি কালী নামে পরিচিত। এখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয় তারপর। তখন থেকে অদ্যাবধি ভাইফোঁটার পরের দিন কালীর বিসর্জন হয়। নিয়ম অনুযায়ী পুজোর দিন ছাগ বলি হয়। অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। বিভিন্ন সংস্কৃতি অনুষ্ঠান হয়। আগে পুজোর সময় তিন দিন ধরে যাত্রাপালার আসর বসত। এখন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। পুজোর প্রণামী হিসাবে পাওয়া কাপড় দুঃস্থ মহিলাদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়। পুজোয় অনেকে দেবী কালিকাকে বেনারসী শাড়ি প্রণামী দেন। শাড়িগুলি দুঃস্থ পরিবারের মেয়েদের বিয়ের সময় দিয়ে দেওয়া হয়। বিসর্জনের দিন দেবীকে চতুর্দোলায় চাপিয়ে বর্ধমানের রাস্তায় বিশাল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।
এবার সবচেয়ে প্রচলিত জনশ্রুতিটি বলি, নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায় পুলিশের নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার প্রতিবাদে বর্ধমানের বিশিষ্ট আইনজীবী গিরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে একটি গোপন বৈঠক হয়। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলাই মুখোপাধ্যায়, শ্রীকুমার মিত্র, রাজকৃষ্ণ দত্ত, তারাপদ পাল, প্রাণদা মুখোপাধ্যায়, প্রণবেশ্বর সরকার প্রমুখ। তাঁরা সকলেই তৎকালীন বর্ধমানের কেউকেটা ব্যক্তিত্ব। বৈঠকে ঠিক হয়, যেকোনও একটি প্রতিমা নিয়ে আইন অমান্য করে নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা করবেন তাঁরা। তখন বারোয়ারী বা সার্বজনীন পুজোর চল ছিল না। কিন্তু বাড়ির প্রতিমা নিয়ে আইন অমান্য করলে বাড়ির মালিকের উপর সমস্ত দায় চাপবে। খোসবাগান সরস্বতীতলার প্রবীণরা যতীন্দ্রনাথ বিষ্ণু মহাশয়ের মাধ্যমে বাগদি পাড়ার কুল গাছ তলার কালী প্রতিমা নিয়ে বাংলার ১৩৪৫ সনের ৩০ কার্তিক রাত্রি ৮ টায় বের হন।
স্থানীয় যুবকরা ঢোল ও কাসি নিয়ে, জনৈক তিনকড়ি মুখোপাধ্যায়ের মাথায় প্রতিমা চাপিয়ে শহর পরিক্রমায় বের হন। বর্ধমান থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অধিকারিক ছিলেন মহম্মদ বাবর আলি। তিনি শোভাযাত্রাকে বাধা না দিয়ে, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে শোভাযাত্রা নিয়ে গিয়ে বিসর্জন করার পর সমস্ত যুবকদের গ্রেপ্তার করেন। তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করেন। বর্ধমান আদালতে আইন অমান্য ও অন্যান্য মিথ্যা অপরাধে তাদের ছয় মাস সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানা হয়। বিনা পারিশ্রমিকে মহামান্য হাইকোর্টে আপিল করেন বর্ধমানের উকিলরা, সকলকে মুক্ত করে আনেন। সেই থেকেই বাগদি পাড়ার দেবী হন ফৌজদারি কালী। কেউ কেউ বলেন, মা কালী পড়ে ছিলেন রাজপথের পাশে।বর্ধমানের বিশিষ্ট আইনজীবীরা বিনা পারিশ্রমিকে মামলা লড়েন। মামলা গড়ায় হাইকোর্ট অবধি। দু'দিন পর, ভাইফোঁটার পরের দিন ফৌজদারী মামলার রায় আসে। ফৌজদারী মামলায় জিতে শোভাযাত্রা-সহ মায়ের প্রতিমা নিরঞ্জন হয় ভাইফোঁটার পর দিন। ফৌজদারী কালীর পুজো ও শোভাযাত্রা মহাধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। আজও ফি বছর ভাইফোঁটার পরদিন শোভাযাত্রা-সহ দেবী প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। গোটা বর্ধমান ঘুরে দেবী ফিরে যান।