বৈষ্ণব পরিবারের হাতে পুজো পান শাক্ত দেবী, বৈচিত্রের বঙ্গেই এ জিনিস দেখা যায়। আনুমানিক সাড়ে তিনশো থেকে চারশো বছর যাবৎ বীরভূমের দুবরাজপুরের পাহাড়েশ্বরে শ্মশান কালীর পুজো হচ্ছে। ওই বৈষ্ণব পরিবারের পূর্বপুরুষ হারাধন চক্রবর্তী কামাখ্যা থেকে দেবী কালীকে এনে দুবরাজপুরের শ্মশানের পাশে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবার শোনা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে এই কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। বীরভূমের মহারাজা রামজীবন চৌধুরী এই মন্দির তৈরি করেন।
তখন এই অঞ্চল ছিল সম্পূর্ণ জঙ্গলে ঘেরা। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে ওঠে, লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে সরে যায় শ্মশান। সারা বছর কালীর পুজো করে বৈষ্ণব পরিবার। শ্মশানকালী পুজো পান তন্ত্র মতে। দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে পুজো দেওয়ার রীতি রয়েছে। দুর্গাপুজোর পর একাদশীর দিন দাস পরিবার প্রতিমা বিসর্জন করে। প্রতিমা বিসর্জনের পর ত্রয়োদশীর দিন থেকে বৈষ্ণব পরিবারের সদস্যরা ফের প্রতিমা গড়তে শুরু করেন, বিসর্জনের পর ওই কাঠামোতেই ফের তৈরি হয় মায়ের মূর্তি।
মন্দিরের পাশে জল কুণ্ডের কাছে মাত্র দুই হাত গর্ত করলেই জল পাওয়া যায়। প্রতিমা তৈরি হওয়ার পর সেই জল শুকিয়ে যায়। একে গঙ্গাকুণ্ডও বলা হয়। অন্যান্য সময় কয়েক ফুট গর্ত খুঁড়েও জল পাওয়া যায় না। প্রতিমা তৈরির সময়, দেবীর অঙ্গরাগের জন্য বাঁশ থেকে শুরু করে যাবতীয় সমস্ত কিছু আসে শ্মশান থেকে। অঙ্গরাগের জন্য শ্মশানের হাড় ব্যবহার হয়। শ্মশানের হাড় থাকে মায়ের মূর্তির অষ্ট অঙ্গে। সূর্যাস্তের আগে মায়ের চক্ষুদান করতে হয়। মায়ের গায়ের রঙ সম্পূর্ণ কালো। কালী প্রতিমার সঙ্গে থাকে সঙ্গী ডাকিনী এবং যোগিনী। মাটির তৈরি মূর্তিটি প্রায় বারো ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট। প্রথমে মূর্তির আকার ছোট থাকলেও, স্বপ্নাদেশ পেয়ে পরে তা বড় করা হয়। মা, শ্মশানকালী নামে পরিচিত হলেও এখানে দক্ষিণাকালী রূপে পূজিতা হন।
দেবী মুক্তকেশী, দিগম্বরী, মুণ্ডমালিনী। তাঁর পদতলে থাকেন শায়িত শিব মূর্তি। কালী পুজোর দিন থেকে সারা বছর পুজো হয়, আশ্বিনের শুক্লপক্ষের একাদশীতে মূর্তি বিসর্জন করা হয়। পুজোর সময় অন্য কেউ উপস্থিত থাকেন না। সমস্ত আলো নিভিয়ে, অন্ধকারে শুধুমাত্র দু’টি প্রদীপ জ্বালিয়ে পুজো হয় শ্মশানকালীর। একটি ঘিয়ের ও অন্যটি তেলের। পুজোর সময় উলঙ্গ হয়ে কাঁটার আসনে বসে পুজো দিতে হয়। আগত ভক্তরা কেবলমাত্র যজ্ঞ দেখতে পান। পুজোয় ভোগ হিসাবে চ্যাং মাছ পোড়া এবং কারন অর্থাৎ মদ দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়।
দূর দূরান্ত থেকে এখানে ভক্তরা আসেন দেবীকে প্রণাম করতে, পুজো দিতে। উমা চলে যাওয়ার পর, একাদশীর দিন শ্মশানে মা কালীর বিসর্জন হয়। কথিত আছে, আগে দুর্গাপুজোর পর দেবীমূর্তির পায়ে শিকল ও দড়ি বেঁধে ঝাঁটা দেখিয়ে, গালিগালাজ করে মন্দির থেকে মাকে বের করা হত। সেই প্রথা আর নেই। রীতি মেনে এখন একাদশীর দিন মূর্তির পায়ে শিকল ও দড়ি বেঁধে বেদি থেকে নামানো হয়। দাস পরিবারের সদস্যরা মায়ের বিসর্জনের দায়িত্ব পালন করেন। উৎসবের চেহারা নেয় মন্দির চত্বর। ফাল্গুনের অমাবস্যায় দেবীর পুজো ও মহোৎসব হয়। সম্প্রতি নতুন মন্দিরের নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয়েছে। শ্মশান কালীর বিসর্জন দেখতে ভিড় জমান অসংখ্য মানুষ। বিসর্জন দেখার জন্য মানুষের ঢল নামে। ভক্তদের বিশ্বাস, সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ করেন শ্মশান কালী।