কালী কথা: আড়াইশো বছরের পুরনো বইপাড়ার দয়াময়ী কালী মন্দির

আজকের কালীকথায় কলকাতার এক কালীর কথা। কালীক্ষেত্র কলকাতার অলিগলিতে রয়েছে অসংখ্য কালী মন্দির। অধিকাংশরই ইতিহাস সুপ্রাচীন। তেমনই একটি কালী মন্দিরের কথা আজ বলব, তিনি বিরাজ করেন খাস বইপাড়া চত্বরে। দেবীর নাম দয়াময়ী কালী, মধ্য কলকাতার কলেজ স্কোয়ারের কাছে রাধানাথ মল্লিক লেনের দয়াময়ী কালীবাড়ি কলকাতার অন্যতম প্রাচীন কালী মন্দির। ১৭৭১ সালে, বাংলার ১১৭৮ বঙ্গাব্দে জগদ্ধাত্রী পুজোর অষ্টমী তিথি গুরুপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় কালো পাথরের দক্ষিণাকালীর মূর্তিসহ দালান স্থাপত্য রীতির মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দুই দালান বিশিষ্ট মন্দিরের গর্ভগৃহে কাঠের সিংহাসনে দয়াময়ী দক্ষিণাকালীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। গর্ভ গৃহেই বিরাজ করেন পীঠরক্ষক হরনাথ শিব ও দামোদর নারায়ণশিলা। মন্দিরে পুজো চলে শাক্ত মতে, কিন্তু এখানে বলিদানের প্রথা নেই। আদৌ ছিল কিনা জানা যায় না, হয়ত শহরের মধ্যে বলেই ছিল না। ১৩৪৫ সনে মন্দিরটি সংস্কার করা হয়।

IMG-20230714-WA0007

দালান রীতিতে তৈরি মন্দিরটি পূর্বমুখী, যদিও মাতৃ মূর্তি কিন্তু দক্ষিণমুখী। মন্দিরগাত্রে মার্বেল ফলকে লেখা রয়েছে- শ্রীশ্রীঁদয়াময়ী, সন ১১৭৮, শ্রীগুরুপ্রসাদ তরে হেরি দিগম্বরী। মন্দিরের প্রবেশ পথে চোখে পড়বে দয়াময়ী ভবন লেখা। কালীর নামে এমন নাম হয়েছে।

দেবী কালিকার বিগ্রহটি কষ্টিপাথরের তৈরি। মাতৃ বিগ্রহের উচ্চতা দেড় থেকে দুই ফুটের মতো। দেবী চতুর্ভূজা দক্ষিণা কালী রূপেই বিরাজিতা। দেবী বামদিকে দুই করে খড়্গ ও মুণ্ড এবং ডান দিকের দুই করে বরমুদ্রা ও অভয়মুদ্রা ধারণ করে শিবের বুকে দক্ষিণ চারণ স্থাপিত করে দণ্ডায়মানা। দেবী কালিকার সারা গায়ে সোনার রূপোর অলংকার পরানো থাকে। মায়ের পায়ের সামনে রাখা থাকে পাঁচটি নরমুণ্ড। কালীমূর্তি একেবারে সাবেকি ধরনের। কোনও বস্ত্র পরানো হয় না। তিনি তাঁর স্বপ্নাদিষ্ট দিগম্বরী রূপটিতেই বিরাজ করেন। প্রায় দু’ফুট উচ্চতার দেবীমূর্তি কারুকার্যময় কাঠের সিংহাসনের উপর অধিষ্ঠিত থাকে। কথিত আছে, মন্দিরের দেবী মূর্তি পুকুরে পাওয়া গিয়েছিল। তারপর সেই পুকুর বুজিয়েই দেবীর মন্দির নির্মিত হয়েছে। দীপান্বিতা কালীপুজোয় আজও অসংখ্য ভক্তসমাগম হয়। পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পুজোতেও এখানে জাঁকজমকপূর্নভাবে পুজো হয়। জগদ্ধাত্রী পুজোর নবমীর দিন মূল পুজো আয়োজিত হয়। পুজোয় মাতৃ আরাধনায় যেমন মা জগদ্ধাত্রীকে পুজো করা হয়, তেমনই পূজিতা হন কালী ও দূর্গা। বাংলার ১১৭৮ সনে বা ইংরেজির ১৭৭১ সালে জগদ্ধাত্রী পুজোর অষ্টমীতে এই কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সময় থেকেই দেবী কালিকার পুজো হয়ে আসছে। মন্দির তথা পুজোর বয়স আড়াইশো পেরিয়ে গিয়েছে। মন্দিরের সেবায়েত বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। তাঁদের হাতেই পুজোর সূচনা হয়েছিল।

১১৭৮ সালে পুজো প্রথম শুরু করেন গুরুপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। শোনা যায়, তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। স্বপ্নাদেশে পাওয়া মায়ের রূপ অনুযায়ীই কালীমূর্তির আদলে এখানে পূজিতা হন জগদ্ধাত্রী। গুরুপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় পর তাঁর মেয়ের হাত ধরে এই পুজোয় যোগদান করে ঘোষাল, মুখোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি পরিবার। দয়াময়ী ভবনের আশপাশের বহু পরিবার এখন পুজোয় সামিল হন।

মন্দিরে রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। এখনও বেদীর উপরে পাঁচটি প্রতীকী মুণ্ড রাখা রয়েছে। বেদীর নীচে রয়েছে আসল পঞ্চমুণ্ডির আসন। দেবীর ভৈরবরূপী দুই শিবলিঙ্গ হরনাথ ও শিবনাথ, মন্দিরের মধ্যেই পৃথক একটি শ্বেতপাথরের বেদীতে প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দিরে বাসুদেব, দামোদর, রাজরাজেশ্বর শালগ্রাম শিলারও নিত্যপূজা করা হয়। মন্দির জগদ্ধাত্রী পুজোর অষ্টমীতে প্রতিষ্ঠিত হাওয়ায়, দেবী সিংহবাহিনীকেও এখানে দেবী জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে পুজো করা হয়। দেবী যেহেতু দীর্ঘদিন পুকুরে ছিলেন, তাই দেবীকে ভোগে মাছ নিবেদন করা হয়। কথিত আছে, শোলমাছ ও চিংড়িমাছ দেবীর অত্যন্ত প্রিয়। দেবীকে মাছ দেওয়া হয়ই। মাছ না হলে দেবী অভুক্তই থাকেন।দেবী দয়াময়ীর মৎস্য প্রীতি নিয়েও বহু জনশ্রুতি, গল্প কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। কথিত আছে, ১৯৭৮ সালের বন্যায় গোটা কলেজ স্ট্রিট অঞ্চল জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। সেই সময় দেবী দয়াময়ীর ভোগ নিবেদন করা সেবায়েতদের কাছে কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেই সময় মন্দিরও জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। মন্দিরে প্রবেশ করা জলে নাকি মাছ ভেসে উঠেছিল। সেই মাছই দেবীকে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়েছিল। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবী এখানে প্রয়োজনে নিজের ভোগ নিজেই জোগাড় করে নেন।

১/কে রাধানাথ মল্লিক লেন, কলকাতা ১২-তে রয়েছে এই মন্দির। সূর্য সেন স্ট্রিটে কর্পোরেশনের পাশ দিয়ে রাধানাথ মল্লিক লেন ধরে ডান দিকে কিছুটা এগোলেই চোখে পড়বে দয়াময়ী কালীবাড়ি। কিছুটা দূরেই দয়াময়ী দুর্গা মন্দির। এখানে এখনও নিত্যপুজো হয়, সন্ধ্যায় আরতি হয়। ভক্তদের বিশ্বাস দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। এখন দয়াময়ী ভবনের কালী পুজোর দায়িত্ব সামলান একাধিক পালাদার। বন্দ্যোপধ্যায়, ঘোষালসহ একাধিক পরিবারের সদস্যরা প্রতিবছর পালা করে করে মাতৃ আরাধনা করেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...