আজ কালী পীঠ বীরভূমের এক কালীর কথা বলব কালী কথায়। সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির অনতিদূরেই রয়েছে দোনাইপুর কালী মন্দির। লাভপুর থেকে বোলপুর যাওয়ার রাস্তাতেই দোনাইপুর অবস্থিত। দোনাইপুরের কালী মন্দিরে তিনটি কালী প্রতিমা বিরাজ করেন। তিনটি কালীই দক্ষিণা কালী। দোনাইপুরের কালী মন্দিরের তিনটি কালী প্রতিমার মধ্যে ডানদিকের কালী বিগ্রহ, স্থানীয় জমিদার পরিবার, চক্রবর্তী পরিবারের টেবা মা কালী। টেবা মা কালী প্রতিষ্ঠিত কালী। টেবা মা কালীর আনুমানিক বয়স তিনশো বছরেরও বেশি। লাভপুরের দোনাইপুর কালীপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তিন শতকের ইতিহাস, ঐতিহ্য। তিনটি কালীর পুজোই ৩০০ বছরের প্রাচীন হলেও, একসঙ্গে প্রায় দেড়শো বছর ধরে এক মন্দিরে তিনজন দেবী পূজিতা হয়ে আসছেন। একসঙ্গে যে তিনটি কালীপুজো হয়ে থাকে, তাদের একটি প্রতিমার উচ্চতা হল ২২ ফুট এবং বাকি দুটির উচ্চতা ১০ ফুট।
তিন কালী প্রতিমাকে তিন বোন হিসাবে পুজো করা হয়। তিনটি প্রতিমার মধ্যে একটি বড়মা এবং অন্য দুটি হল টেবা মা ও বিশ্বেশ্বরী মা। প্রতি বছর প্রায় একই উচ্চতার প্রতিমার পুজো হয় এখানে। জনশ্রুতি রয়েছে, এখানে যিনি পুজো করতেন তিনি চোখে দেখতে পেতেন না। যে কারণে সবাই তাকে কানাকর্তা বলে ডাকতেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল কালীপুজোর দিন কিন্তু তিনি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেতেন। এলাকার মানুষজনের কাছে শোনা যায়, কানাকর্তা গোটা বছর অন্ধ থাকার পর কালী পুজোর রাতে মায়ের চক্ষুদানের পরে দেখতে পেতেন। আবার মায়ের ঘট বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার অন্ধ হয়ে যেতেন। তিনি সম্ভবত ভিক্ষা করে খেতেন। কানাকর্তাই প্রথম টেবা কালীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে টেবা মায়ের ইচ্ছেয় কানাকর্তা পুত্রসন্তান লাভ করেছিলেন। টেবা মায়ের আশীর্বাদে পাঁচ পুরুষ পরে কানাকর্তার বংশে পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছিল। এরপরই মায়ের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে। হাঁপানি, পেটের সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব দোষ ইত্যাদি নানান সমস্যা নিয়ে দোনাইপুর কালী মায়ের মন্দিরে ভক্তরা ভিড় করেন। স্থানীয় মানুষজন বলেন, দোনাইপুর কালী মন্দিরে এলে তাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান হবে। তাই আজও বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষ দোনাইপুরের কালী মায়ের মন্দিরে আসেন।
মন্দিরে মানসিক করার চল রয়েছে। কঠিন রোগ নিরাময়ের জন্য ভক্তরা ষোলো আনা, ষোলো কলা, এক ঘড়া গঙ্গা জল, পাঁঠা ইত্যাদি মানত করেন। বন্ধ্যাত্ব নিরাময়ের জন্য শাখা, সিঁদুর, আলতা ও লালপেড়ে শাড়ি মায়ের কাছে মানত করা হয়। দোনাইপুর কালী মন্দিরের সেবায়েতরা গাছ-গাছালীর শিকড়, ফুল, চরণামৃত এবং টেবা মায়ের স্বপ্ন প্রদত্ত ওষুধ দেন।
দোনাইপুরের কালী মন্দিরের বাঁদিকের কালী প্রতিমাটি বিশ্বেশ্বরী কালী নামে পরিচিতা। তিনি মুখার্জীদের কালী নামেও পরিচিত। এই মূর্তিও বয়সে আনুমানিক তিনশো বছরের পুরনো। মুখার্জীরা নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁরাই এই পুজোর শুরু করেন। আজও কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে মহেশপুর থেকে দোনাইপুরে এসে মহেশপুর গ্রামের সেবায়েতরা মুখার্জীদের কালী পুজো করে যান। দোনাইপুরের কালী মন্দিরের মাঝের কালী প্রতিমার উচ্চতা সবচেয়ে বেশি, তিনি বড়মা কালী। বড়মা কালী একুশ হাত লম্বা। লাভপুরের জমিদার বন্দ্যোপাধ্যায়দের কাছারি বাড়ি ছিল দোনাইপুর গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে। সেই কাছারি বাড়িতেই বড়মা কালী পূজিতা হতেন। জমিদারী বিলোপের পর, জমিদার পরিবারের লোকজন দোনাইপুরের চক্রবর্তী পরিবারের উপর পুজোর দায়িত্ব দেন। দুই পরিবারের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। চক্রবর্তীরাই বংশ পরম্পরায় দোনাইপুর কালী মন্দিরের দায়িত্ব পালন করছেন।
আদপে তিন কালী প্রতিমাই দোনাইপুর গ্রামের তিনটি পৃথক পৃথক স্থানে পূজিতা হতেন। আজ থেকে আনুমানিক ষাট বছর আগে দোনাইপুর গ্রামের সকল গ্রামবাসীরা মিলে তিন কালী প্রতিমাকে এক জায়গায় পুজো করার সিদ্ধান্ত নেন। তাল পাতার ছাউনির কালী মন্দির ছিল কানাকর্তার আমলে। পরে মাটির ঘর ও খড়ের চালার মন্দির তৈরি হয়। ২০১৪ সালে গ্রামবাসীরা পাকা মন্দির তৈরি করে। কালী মন্দিরে তিনটি কালী প্রতিমার নিত্য পুজো হয়। সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার এবং প্রতি অমাবস্যায় বিপুল ভক্ত সমাগম হয়। দোনাইপুর কালী মন্দিরে রাতে পুজো হয় না। একমাত্র কার্তিক মাসের অমাবস্যায় কালীপুজোর সময় রাতে পুজো হয়। কার্তিক মাসে কালীপুজোর সময় রাত বারোটার পর ঘট আনা হয়। নিশি পুজো হয়। রাত বারোটার পর পুজোর ঘট আসে৷ প্রথমে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী পুজো হয়৷ তারপর ঘটে গঙ্গাজল ভরে আনা হয়৷ তারপর বিশ্বেশ্বরী মা-র ঘট আনা হয়৷ সেদিন অন্ন ভোগ হয় না। কালীপুজোর রাতে ভোগ হিসেবে চিঁড়ে, লুচি, খইয়ের নাড়ু, চিনির নাড়ু আর ফলমূল প্রদান করা হয়। দোনাইপুর কালী মন্দিরে ৯ দিনের আগেই কালী প্রতিমা বিসর্জনের একটা চল তথা রীতি রয়েছে। এখানকার কালীপুজোয় কালী প্রতিমাগুলির বিসর্জনের সময় বিজয়া দশমীর মতো সিঁদুর খেলার আয়োজন করা হয়। তিনটি কালী প্রতিমার মধ্যে বড় মায়ের পুজো গ্রামের বাসিন্দাদের থেকে চাঁদা তুলে করা হয় এবং বাকি দুই মায়ের পুজো পারিবারিকভাবে করা হয়।
এই মন্দিরে আজও বলিদান চলে। কালী পুজোর দিন দোনাইপুর কালী মায়ের মন্দিরে কমবেশি আটশো পশুর বলিদান হয়। টেবা মায়ের সামনে প্রথমে ছাগ তারপর মেষ বলি দেওয়া হয়, লাভপুরের জমিদার বংশের বড়মা কালীর ও মুখার্জী বাড়ির বিশ্বেশ্বরী মায়ের সামনেও প্রথমে ছাগ বলি দেওয়া হয়। দোনাইপুরের কালীমায়ের বিসর্জনে একদা খুব ধূম হত। কালীদহে বিসর্জনের আগে মাকে দোনাইপুর গ্রামের শেষপ্রান্তে ঘুটিনডাঙায় রাখা হত। মা যেহেতু ওই স্থানে বিশ্রাম নিতেন, তাই এলাকার মানুষজনের কাছে জায়গাটি বিশ্রামশালা নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। তবে এখন মন্দিরের পাশের পুকুরেই বিসর্জন হয়। কালীপুজোর আট দিনের মাথায় বিসর্জন হয় তিনটি কালী প্রতিমার।
দোনাইপুর কালী মন্দিরে আজও খুঁটো বাঁধা প্রথার প্রচলন রয়েছে। মানসিক থাকলে কালীমায়ের সামনে খুঁটিতে পশু বেঁধে দিয়ে যান। মনস্কামনা পূরণ হলেও অনেকে দোনাইপুর কালীমায়ের মন্দিরের সামনের খুঁটিতে মানসিক অনুযায়ী পশু বেঁধে দিয়ে যান। পুজোর দিন প্রতিবছরই পাঁঠা বলি দেওয়ার প্রচলন রয়েছে৷ যা আজও অব্যাহত৷ গত বছর ৮০০ পাঁঠা বলি দেওয়া হয়েছে৷ প্রতি বছরই পাঁচশোর বেশি পাঁঠা বলি দেওয়া হয় এই কালী মন্দিরে৷ পুজোকে কেন্দ্র করে মেলাও বসছে বিগত কয়েক দশক যাবৎ৷ কালী পুজোর দিন প্রায় সাত থেকে আট হাজার মানুষ ভিড় জমান এই কালী পুজো দেখতে। পুজো উপলক্ষ্যে কবিগান, কীর্তন, যাত্রা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷ কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বাঁকুড়া এমনকি ঝাড়খণ্ড থেকেও ভক্তরা আসেন৷