বাংলা ও বাঙালির বারোমাসে তেরো(?) পার্বণ। তার মধ্যেই অন্যতম দোল উৎসব অথবা হোলি। এই দোল অথবা হোলির উৎপত্তি কীভাবে? এই উৎসবের সঙ্গে রঙের সম্পর্ক কীভাবে? রইল তারই কিছু ইতিবৃত্ত।
'দোল' সাধারণত পূর্ণিমা তিথিতে পালন করা হয়। দোল এবং হোলি দু'টি আলাদা অর্থ হলেও দু'টি মোটামুটি একই বিষয়। কথিত আছে হোলি কথাটি “হোলিকা” থেকে সৃষ্ট। হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ এবং দিতির ছেলে হিরণ্যকশিপুর বোন। আর হিরণ্যকশিপুর ছেলে ছিলেন প্রহ্লাদ। প্রহ্লাদ অসুরবংশে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও ছিলেন প্রভু বিষ্ণুর ভক্ত। সেই কারনেই তাঁর পিতা তাঁর উপর ভীষণ ক্রুদ্ধ ছিলেন, কারন প্রহ্লাদ প্রভু বিষ্ণুকে তার পিতার উপর স্থান দিয়েছিলেন। তাই তাঁর পিতা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিজের ছেলেকে হত্যা করবেন।
প্রহ্লাদ ছিলেন প্রকৃত ধার্মিক। তাই তাঁকে হত্যা করা সহজ ছিল না। কোনভাবেই তাঁকে হত্যা করা যাচ্ছিল না। তখন হিরণ্যকশিপু তার ছেলেকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন। অন্যদিকে হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা 'আগুনে কোন দিন ক্ষতি হবে না' এই বর পেয়েছিল। তাই প্রহ্লাদকে হত্যা করার জন্য হোলিকা সিধান্ত নেয় সে প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেবে। এবং সে তাই করে, প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু বর পাওয়া সত্ত্বেও সেদিন শেষ রক্ষা হয়নি। প্রহ্লাদ বিষ্ণুর আশীর্বাদে বেঁচে যায়, আগুনে ভস্ম হয়ে যায় হোলিকা। সেই দিনটি থেকে পালন করা হয় হোলি।
হোলিকার এই কাহিনি চাঁচর বা হোলিকাদহন নামে পরিচিত, যা দোলের আগের দিন পালন করা হয়। অথবা যা সাধারণত 'নেড়াপোড়া' বলে অভিহিত। নেড়াপোড়ার দিন শুকনো ডালপালা, গাছের শুকনো পাতা দিয়ে বুড়ির ঘর করা হয়। এবং হোলিকার উদ্দেশ্যে সেই ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হোলিকাদহন পালন করা হয়। অনেক আবার হোলিকার উদ্দেশ্যে মাটির পুতুল বানিয়ে ওই শুকনো ডালপালার ঘরে রেখে জ্বালিয়ে দেয়। পরের দিন উদযাপিত হয় দোল উৎসব।
আবার এও কথিত রয়েছে, বসন্ত পূর্ণিমার দিনে শ্রীকৃষ্ণ, কেশি নামে একজন অসুরকে বধ করেন। এই অত্যাচারী অসুর দমন এবং অন্যায় শক্তি ধ্বংস হওয়ার জন্য আনন্দ উৎসবে এই দিনটি উদযাপিত হয়ে থাকে।
অন্যদিকে বৈষ্ণবরা বিশ্বাস করেন দোল পূর্ণিমার দিন শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে রাধাকে নিয়ে আবির মাখিয়ে রঙ খেলায় মেতে ছিলেন। এবং সঙ্গে ছিলেন তাদের গোপীগন। তারপর থেকে দোলের দিন আবির নিয়ে রঙ খেলার সূচনা হয়।
দোল পূর্ণিমাকে 'গৌর পূর্ণিমা'ও বলা হয়। শ্রী গৌরাঙ্গ এই ফাল্গুনি পূর্ণিমাতেই নদিয়ায় নিজের আবির্ভাব ঘটান; অবতরণ করেন তাঁর ভাবের। মা শচিদেবী সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘নিমাই’, তাঁর রূপের জন্য পাড়ার লোক নাম দিয়েছিল ‘গোরা’ (গৌরাঙ্গ), গুরু নাম দিয়েছিলেন কৃষ্ণচৈতন্য, সেখান থেকেই চৈতন্য। তিনি নদিয়ার প্রথম ‘ফকির’। নদিয়ার সাধকদের কাছে তিনি ‘ফকির’ বলেই প্রসিদ্ধ। গৌর পূর্ণিমা নদিয়াবাসীদের জন্য জয়ধ্বনির দিন; নদের নিমাইয়ের আবির্ভাব মুহূর্তের হিসাব ধরেই পালিত হয় 'গৌর পূর্ণিমা', এই দিনই সকলে মেতে ওঠেন রঙের খেলায়, 'দোল উৎসব'-এ।