কেমন হবে মায়ের গাত্রবর্ণ? শাস্ত্র বলছে, দুর্গা হবেন অতসীপুষ্পবর্ণা, গ্রামবাংলায় যে অতসী ফুল দেখা যায় তার বর্ণ সোনার মতো। তেমনই দুর্গা গড়েন বাংলার পটুয়ারা। কিন্তু বাংলা মানেই ব্যতিক্রম। নদীয়ায় পূজিতা হন নীল দুর্গা। একই পরিবারের দুই শরিকের বাড়িতে নীল দুর্গার আরাধনা চলে। দুর্গার নাম থেকেই বাড়ির নাম হয়ে গিয়েছে নীল দুর্গাবাড়ি।
কৃষ্ণনগর নাজিরাপাড়ায় চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গামূর্তি নীল। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বরিশাল জেলার রামরাইন গ্রামে, সেখানেই পুজোর সূত্রপাত। প্রথম থেকেই মূর্তি নীল রঙের ছিল না। শোনা যায়, প্রতিমা শিল্পী রাতের অন্ধকারে ভুল করে নাকি দেবীমূর্তির গায়ের নীল রঙ করে ফেলেছিলেন। চালির রঙ প্রতিমার গায়ে আর প্রতিমার হলুদ পড়েছিল চালিতে।
নদিয়ায় আবার লাল দুর্গারও দেখা মেলে, লাল দুর্গার পুজো হয় নবদ্বীপের যোগনাথতলার ভট্টাচার্য বাড়িতে। দুর্গামূর্তি লাল হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে এক গপ্পো। সে কাহিনি বড় মর্মান্তিক। ঘটনাটি ওপার বাংলার। ভট্টাচার্যদের আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ঢাকা জেলার মিতরা গ্রামে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই পরিবারের দেবীর গায়ের রং প্রথম থেকে এমন রক্তবর্ণ ছিল না। সতেরো শতকের ঘটনা, পুজো উপলক্ষ্যে ভট্টাচার্য পরিবারের গৃহকর্তা রাঘবরাম ভট্টাচার্য নবমীর দিন চণ্ডীপাঠে বসেছেন, পুজোর বিশেষ তিথি পেরিয়ে যাচ্ছে, তাই একটু দ্রুতই পাঠ করছিলেন। পাশেই ছিলেন রাঘবরামের তৃতীয় পুত্র রামভদ্র, তাঁর কানে বাধে বাবার উচ্চারণ। বাবার চণ্ডীপাঠকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে হয় তাঁর। বাবাকে বলেন। ছেলের মুখে নিজের দোষের কথা শুনে রেগে যান রাঘবরাম। চণ্ডীপাঠ থামিয়ে ছেলেকেই আদেশ করেন চণ্ডীপাঠ করতে। বাবার আদেশে পূর্বদিকে মুখ করে চণ্ডীপাঠ করতে বসলেন রামভদ্র। শুরু হল বাবা আর ছেলের একইসঙ্গে চণ্ডীপাঠ।
এমন সময় হঠাৎই দিক পরিবর্তন করলেন দেবী, দক্ষিণমুখী থেকে ঘুরে পশ্চিমমুখী হয়ে একেবারে রাঘবপুত্রের দিকেই যেন ঘুরে দাঁড়ালেন মা। চণ্ডীপাঠ চলল আর দেবীর গায়ের রঙ বদলাতে থাকল ধীরে ধীরে। লাল বর্ণ ধারণ করলেন দেবী, অন্যদিকে রামভদ্রের সারা শরীর ক্রমেই রক্তশূন্য হয়ে গেল। চণ্ডীপাঠ শেষ হল, আর রামভদ্রও মারা গেলেন। আজও দেবী এখানে পশ্চিমমুখী। এ বাড়িতে পুজোয় চণ্ডীপাঠ নিষিদ্ধ।
কালো দুর্গা, হ্যাঁ বঙ্গে একাধিক জায়গায় কৃষ্ণ বর্ণের দুর্গার দেখা মেলে। অতসী শব্দের অভিধানিক অর্থ ক্ষুমা আর ক্ষুমা ফুলের বর্ণ কালো।
বেলেঘাটার রামকৃষ্ণ নস্কর লেনের ভট্টাচার্য বাড়িতে দেবীর গায়ের রঙ কালো। প্রায় তিনশো বছর ধরে কালো দুর্গা পূজিতা হচ্ছেন। হরিদেব ভট্টাচার্যর হাত ধরে পাবনায় এই পুজো শুরু হয়েছিল।
নদিয়া জেলাতেও কালো দুর্গার আরাধনা হয়। হাঁসখালির বাহিরগাছি গ্রামে দেবীমূর্তির গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। এই আশ্রমের। যা এলাকায় শান্তি আশ্রম বলে পরিচিত। একসময় এই পুজো ছিল বাংলাদেশের পাবনা জেলার স্থলগ্রামের জমিদারবাড়ির। সেই বাড়ির ভভূপেশচন্দ্র ভট্টাচার্য হিমালয় ভ্রমণে বেরিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যান, বাহিরগাছিতে এসে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে দুর্গাপুজো শুরু করেন। জানা যায়, ভুল করে দেবীর গাত্রে কালো রঙ করে ফেলেছিল মৃৎশিল্পী। ঘুমের ঘোর রঙ করতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধে, তারপর দেবীই স্বপ্নাদেশে জানা কৃষ্ণ বর্ণের রূপেই পুজো হোক।
ক্যানিংয়ের ভট্টাচার্য পরিবারের দুর্গাপ্রতিমার মুখের রঙ কালো, গাত্রবর্ণ বাদামি। এক অগ্নিকাণ্ডের জেরে এই রূপেই সৃষ্টি। ঢাকা-বিক্রমপুরের বাইনখাঁড়া গ্রামে ৪৩৯ বছর আগে সূচনা হয়েছিল এই পুজোর। খড়ের ছাউনির মাটির শনি মন্দির ও কালী মন্দিরে দুর্গা পুজোর আয়োজন করা হত। পাশে আরেকটি মন্দিরে মনসা পুজো হত। প্রায় ২০০ বছর আগে দুর্গাপুজোর ঘটে দুর্ঘটনা। হঠাৎই একটি কাক মনসা মন্দির থেকে প্রদীপের জ্বলন্ত সলতে ঠোঁটে তুলে নিয়ে এসে দুর্গা মন্দিরে খড়ের চালে বসে, তারপরই ঘটে যায় ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ড। আগুনে পুড়ে যায় দুর্গা প্রতিমার অনেকটা অংশ। প্রতিমার গা হয়ে যায় বাদামি আর মুখ কালো। পরিবারের এক সদস্যকে স্বপ্নাদেশে মা জানান, প্রতিমার মুখের রঙ হবে কালো, আর গায়ে গাঢ় বাদামি রঙ করেই পুজো করতে। স্বপ্নাদেশ মেনেই শুরু হয় পুজো। দুর্গা বঙ্গে তপ্তকাঞ্চনবর্ণা ছিলেন। কখনও ভুলবশত, কখনও বা দুর্ঘটনার জেরে তাঁর গাত্রবর্ণ বদলে গিয়েছে।