নদীর পাড় ধরে ভেসে চলেছে রানি রাসমণির নৌকা। মন বড় অস্থির।
একদিন চোখে পড়ল লাল পাড় সাদা শাড়ি, খোলা চুলের এক ছোট্ট মেয়ে তাঁকে ডাকছে তীরের মাটি থেকে। নোঙর করতে বললেন নৌকা। সেই মেয়ে তাঁকে নিয়ে গেল নিস্তারিণীর মন্দিরে। আর তাকে দেখা যায়নি। তবে সেই স্মৃতি রয়ে গিয়েছিল রাণী রাসমনির স্মৃতিতে।
একবার রানি রাসমনি আত্মীয় এবং পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বারাণসীতে তীর্থযাত্রার আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু এক স্বপ্নাদেশে বাতিল করেন সেই যাত্রা। স্বপ্নে তিনি আদেশ পান বারানসীতে নয়, এই গঙ্গার তীরে বাংলার বুকেই রাণীর হাতে পুজো চান দেবী।
সেই স্বপ্নাদেশেই মন্দির প্রতিষ্ঠার ভাবনা শুরু করেছিলেন তিনি। তাঁর দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজটি কিন্তু সহজ ছিল না। সমাজ এবং সময়ের সঙ্গে বিরোধ বেঁধে ছিল তীব্রভাবে।
মন্দিরের জন্য জমির খোঁজ শুরু হতেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন এ কাজ কত কঠিন!
প্রথমে তাঁর নিজের পৈতৃক বসত হালি শহরে মন্দিরের জন্য জমি খুঁজছিলেন। কিন্তু পছন্দমতো জমি পাননি। অনেক খোঁজের পর অধুনা উত্তর পরগণা জেলার কামারহাটিতে। মন্দিরের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি জেনারেল জেমস হেস্টি সাহেবের থেকে। রাণী রাসমনির দলিল থেকে জানা যায়, এখানকার মোট সাড়ে চুয়ান্ন বিঘা স্থানটি ৪২হাজার ৫০০টাকায় কিনেছিলেন-কুঠিবাড়ী সমেত। ২৪ পরগণার দক্ষিণেশ্বর গ্রামের এই স্থানটি তখন জলা-জঙ্গলে পূর্ণ ছিল। একটি দরগাও ছিল।
১৮৪৭-তে শুরু হয় দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণের কাজ। শেষ হয় ১৮৫৫ সালে। ১৮৫০ সালে এই মন্দির নির্মাণের দায়িত্বে ছিল ম্যাকিনটোশ বার্ন লিমিটেড।
১৮৫৫ সালের ৩১ মে, স্নান যাত্রার দিনে এই মন্দিরে পন্ডিত রামকুমার চট্টপাধ্যায় মায়ের বিগ্রহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই দেবীর নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে শ্রী শ্রী জগদীশ্বরী কালীমাতা ঠাকুরানি। লোকমুখে মা ভবতারিণী। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে দেবী কালী ভবতারিণী রূপে পূজিতা।
এই মন্দির রাসমনির স্বপ্ন। ১০০ ফুট উচ্চতার সনাতন নবরত্ন মন্দির তৈরি করতে খরচ হয়েছিল সেই সময়ে ৯ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। দক্ষিণমুখী মন্দিরের তিনটি চূড়া। সিঁড়ি পার হয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়।
মন্দিরের গর্ভগৃহে কালো পাথরের ওপর ভবতারিণী শ্যামাকালীর মাতৃমন্দির। দেবীর পদতলে রুপোর পদ্মফুলের ওপর শয়ানে শ্বেতপাথরের মহাদেব। ৪ ফুট বাই ২৪ ফুট একটি ঘরেই মায়ের বিগ্রহ থাকে, যার ৮ ফুট বাই ৮ ফুট স্থান জুড়ে রয়েছে দেবীর সিংহাসন। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহ অতি সুরক্ষিত স্থান। মন্দিরে দেবীর বিগ্রহকে পুরোহিত ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারেন না।
প্রধান মন্দিরের বিপরীত দিকে দ্বাদশ শিবের মন্দির। আটচালা স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। প্রধান মন্দিরের
উত্তরে রয়েছে 'শ্রীশ্রীরাধাকান্ত মন্দির' নামে পরিচিত রাধাকৃষ্ণ মন্দির এবং দক্ষিণে রয়েছে নাটমন্দির।
রাণী রাসমনি, শ্রী রামকৃষ্ণ দেব এবং সারদা দেবী এবং বিবেকানন্দের স্পর্শে এই ভূমি অত্যন্ত পবিত্র বলে লোকবিশ্বাস।
মন্দির নিয়ে নানা ভাবে সংকটে পড়তে হয়েছিল রাণী রাসমনিকে। অব্রাহ্মণ স্ত্রীলোক দেবী-মন্দির প্রতিষ্ঠা করবে এটা মেনে নিতে পারেনি সে সময়ের সমাজ। কেউ রাজী হল না মন্দিরের দায়িত্ব নিতে। সকলের মতেই তিনি ‘অশাস্ত্রীয় কাজ’ করেছেন। শেষপর্যন্ত কামারপুকুর থেকে আগত পুরোহিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায় বিধান দেন মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে যদি কোনও ব্রাহ্মণ বংশীয়কে দান করা যায় এবং মন্দির পরিচালনার জন্য ধার্য অর্থ সেই পুরোহিতের তাহলে সমস্যা থেকে রেহাই মিলতে পারে’।
রামকুমার তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামকৃষ্ণকে(গদাধর) নিয়ে রানি রাসমণির ইচ্ছায় বৃহস্পতিবার স্নানযাত্রার দিন ১৮৫৫সালে ৩১শে মে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
বিধান দেওয়ার কারণে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কেও সমাজপতিদের রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল।
রাণী রাসমনি মন্দিরের ভার তুলে দেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিলেন। দিনাজপুরের জমিদারি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ধার্য করে দিলেন। গদাধর তথা শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের মন্দিরে পদার্পণ রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সূত্রেই। তাঁর সাধন ক্ষেত্র ছিল এই মন্দির। সারদা দেবী মন্দির নহবতখানায় থাকতেন। এই নহবতখানাই এখন সারদা দেবীর মন্দির। ১৮৮৬ পর্যন্ত প্রায় তিরিশ বছর শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে অবস্থান করেন।
দক্ষিণেশ্বরে পুরোহিত পাওয়া নিয়ে যেমন সংকট ঘনিয়েছিল তেমনি বিরোধ তৈরি হয়েছিল সাধারণ মানুষের মনেও। পুজোতে দূরের কথা, মন্দিরে ভোগ বা প্রসাদ নিতেও সহজ ছিল না মানুষ।
দক্ষিণেশ্বর মন্দির নিয়ে অজস্র মিথ আর গল্প রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা প্রবাহিত হয়ে আসছে।
মন্দির উদ্বোধনের দিন কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয়ে ঐতিহাসিক উৎসব হয়েছিল। রাসমণি "অন্নদান-যজ্ঞ" করেছিলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্রাহ্মণরা এসেছিলেন মন্দির প্রতিষ্ঠার উৎসবে যোগ দিতে।
ভক্ত-পুন্যার্থীর আগমনের সেই ধারা আজও বহমান। ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব যে ভাবে চার প্রহরে নিত্য মহা পুজো করতে ঠিক সেভাবেই আজও পুজো হয় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। দেশ বিদেশ থেকে ভক্তরা আসে এই পুণ্যভূমিতে মাতৃদর্শন করতে।