সাইকেল কথা

সাল ১৮৮৬। ইংরেজির ১৩ই সেপ্টেম্বর। শ্রাবন পেরিয়ে সবে ভাদ্র মাসের আগমন কলকাতায়। তাই বর্ষার মেঘ পুরোপুরিভাবে তখন যায়নি। তবে তারই ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সোনালী রোদ্দুর। সেইদিন কলকাতায় সকাল থেকেই একটা সাজোসাজো  রব। ময়দানে এক এক করে জোকারের দল আসছে। মনে হচ্ছে কে যেন আসবে! সাহেবদের আনাগোনা তো আছেই। কিন্তু কে আসবে? অবশ্যই কোনো স্বনামধন্য ব্যক্তি তো বটেই। ইতিমধ্যেই মানুষের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে পড়েছে। এরপরেই প্রবেশ করলেন 'টমাস স্টিভেন্স'।

  কে এই টমাস স্টিভেন্স? জানা গিয়েছে, এই ব্যক্তি প্রথম সাইকেল চেপে বিশ্বভ্রমণ করেছিলেন। ১৮৮৪ সালে সান ফান্সিসকো থেকে রওনা হয়েছিলেন তিনি। এরপর শুরু হল তার দু চাকার যানটিতে চড়ে বিশ্ব ভ্রমণ। তবে একথা বলা যায়, সারা বিশ্ব ঋণী এই যানটির কাছে। কারণ এখানে নিজের চালক নিজেই তাই অন্যের উপর কোনো জুলুম নেই। ধনি গরিবের কোনো ভেদাভেদ নেই এর কাছে। তেল বা গ্যাস কোনো কিছুরই ধার ধারেনা এটি। তবে দূষণমুক্ত যানটির কদর বেশ। তাই এমন কোনো মানুষ নেই যে এই দুচাকা যানটির প্রেমে পড়েনি। কলকাতাও পড়েছিল এর প্রেমে। যে প্রেম এখনো ফিকে হয়নি।কলকাতার ইতিহাসে অনেক যানই এসেছে গেছে। যেমন ধরুন পালকি, ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়ায়  টানা ট্রাম, দোতলা বাস। তবে সাইকেল কিন্তু একদম অন্যরকম।

   এই যানবাহনটিকে ঘিরে কলকাতার আকাশেবাতাসে ছিল বেশ রোম্যান্টিকতা। জানা গিয়েছে যে, এককালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সাইকেলে চেপে প্ৰাতঃ ভ্ৰমণে বেরোতেন। তবে সেই সময়ে ছিল ট্রাই সাইকেল। তবে তারও আগে ছিল 'ট্যান্ডেম'। এই সাইকেলটি একসাথে অনেকে মাইল চালানো যেত। তবে জানা গিয়েছে যে, এই ট্যান্ডেম সাইকেলটি তৈরী করেছিলেন সাঁত্রাগাছির বাসিন্দা প্রসন্নকুমার ঘোষ। ভারতে তার তৈরী সাইকেলই ছিল প্রথম সাইকেল। তবে সেই সময়ে অবস্থাপন্ন বাড়ির লোকজন বিলেত থেকেই আনাতেন 'ভেলেসিপেড' সাইকেল। এই সাইকেলের প্যাডেল ছিলোনা। পা দিয়ে ঠেলে নিয়ে যেতে হত। তবে এই সাইকেল জগতের বিখ্যাত সাইকেল ছিল 'পেনিফারদিং'। সাইকেলের সামনেটা ছিল বিশাল আকৃতির কিন্তু পেছনটা ছিল আকৃতিতে ছোট। ইন্দিরা দেবীর লেখায় কলকাতায় এই সাইকেল চালানোর বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৯ শতকের শেষ দশকে সাইকেল চালানো ছিল রীতিমত ফ্যাশন। সাহেবদের সাইকেল চড়ে আড্ডা দিতে যাওয়া থেকে, ডাক্তারের রুগী দেখতে যাওয়া এই যানটি ছিল একমাত্র সঙ্গী।

তবে এই দুচাকার যানবাহনের ভেলকি কম নয়। সাইকেল নিয়ে মানুষের এমন মাতামাতি যে ১৮৯৭ সালে বেঙ্গল সাইকেলিস্ট অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করা হল।

জগদীশ বসু বলেছিলেন,

আজকাল বাইসাইকেল আমাদের পুষ্পক রথ।

কলকাতার প্রথম সাইকেল দোকান ছিল হ্যারিসন রোডে। জানা গিয়েছে, প্রেসিডেন্সি কলেজের পাশেই ছিল এই দোকানটি। সেসময়কার বেশ নামিদামি লোকেরাও সেই দোকানে যেতেন। তাই সাইকেল কলকাতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ গোয়ালার দুধ বিক্রি করতে যাওয়া এই সাইকেল নিয়েই, পোস্টম্যানের চিঠি বিতরণ করতে যাওয়াও এই সাইকেলে চড়েই। তাছাড়া সেই সময়কালে মাস্টারমশাই এই সাইকেলে চড়েই পড়াতে আসতেন। এছাড়া ছাত্রের সাইকেল, পালানোর জন্য সাইকেল, এর পাশাপাশি বাংলার উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে এর ব্যবহার ছিল অবাধ। "দেখবো এবার জগৎটাকে" এই নেশাটাকে আরও উস্কে দিয়েছিল বাইসাইকেল।

 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...