কলকাতার বিহারি সম্প্রদায় ও ছট্ পুজো

আমাদের প্রতিটি মহানগরই এক একটি মিনি ভারতবর্ষ। কারণ, ভারতের প্রতিটি ধর্ম, প্রতিটি জাতির মানুষ তাঁদের নিজের নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে অবস্থান করেন সেখানে। স্বভাবতই আমাদের কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই মহানগরে বিপুল সংখ্যায় রয়েছেন পশ্চিমের মানুষ, যাঁদের একটা অংশকে আমরা 'বিহারি' বলি।  বিহারিরা কিন্তু কলকাতায় উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষ নন। 

তিন'শ বছর আগে যখন জোব চার্ণক কলকাতায় এসে ভিড়লেন, তখন এখানকার মাটিতে লাল দিঘির পাশে কেবল সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছারি বাড়ি, বাবুঘাট অঞ্চলে জেলেদের কিছু গোলপাতায় ছাওয়া মাটির ঘর, বাগবাজার অঞ্চলে নদীর ধারে একটা অস্থায়ী হাট আর ভবানীপুর অঞ্চলে ছোট্ট একফালি জনপদ। এছাড়া আর কিই বা ছিল! তবু জোব চার্ণকের হাত ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসার আড্ডা গেঁড়ে ফেলল এখানেই। সাহেব কর্মচারীরা কেউ একা, কেউ কেউ মেম নিয়ে কালাপানি পেরিয়ে হাজির হল। জমে উঠল সাহেবসুবোর ভিড়। গড়ে উঠল কোম্পানির অফিস-কাছারি, গড়ে উঠল সাহেব-কলোনি। গ্রাম কলকাতা হয়ে উঠল নগর। গুলজার হল গড়ে ওঠা সেই নগর কলকাতা।

ইংরেজ সাহেব এবং মেমরা এই নতুন নগরে এসে সংসার গড়তেই প্রয়োজন পড়ল বাসা এবং অফিসের জন্য প্রচুর কাজের লোক। পাখাবরদার, জুতোবরদার, ভৃত্য, রাঁধুনি, বাজার-সরকার, পালকি-বেহারা, কোচওয়ান, ভিস্তিওয়ালা, গাড়োয়ান, মালি, নর্দমা-সাফাইকর্মী, ঝাড়ুদার প্রভৃতি। ভৃত্য, রাঁধুনি ও বাজার-সরকারের কাজ ছাড়া অন্যান্য কাজগুলোর জন্য নগরের আশপাশের হতদরিদ্র মানুষেরাও এগিয়ে এলেন না। 'হীন'-কাজের দোহাই দিয়ে দূরেই রইলেন। ফলে, কাজের লোকের জন্য নবাগত ইংরেজদের হাপিত্যেশ করে তাকাতে হল পশ্চিমের দিকে। স্বয়ং জোব চার্ণক এসব কাজের জন্য পাশের রাজ্য উড়িষ্যা এবং পশ্চিম ভারত থেকে প্রচুর মানুষ এনে কলকাতায় বসালেন। পশ্চিমের মানুষদের মধ্যে একটা বড় অংশই কিন্তু ছিলেন 'বিহারি'।

উত্তর প্রদেশ ও সেকালের বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখন রুক্ষ্মমাটিতে জলের অভাবে চাষের খুব সমস্যা, কাজেই কাজকর্মের আকাল। তাই পেটের দুশ্চিন্তা এই অঞ্চলের মানুষকে টেনে এনেছিল নতুন নগরটিতে, বাধ্য করেছিল তথাকথিত 'হীন' কাজ মাথায় তুলে নিতে। গ্রামের এই মানুষগুলো কিন্তু একেবারেই খালি হাতে আসেননি; সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের লোক-উৎসব ও পার্বণের ঐতিহ্য। আমাদের পরিচিত ছট্ পূজার সংস্কৃতিও। ফলে, সেই সময় থেকেই কলকাতায় লালিত ও উদযাপিত হয়ে আসছে বিহারি সম্প্রদায়ের ছট্ পুজো।     

পৃথিবীর সব দেশেই লোকসংস্কৃতির একটা বড় অংশের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে প্রকৃতি পুজোয় কৃষির ঐতিহ্য। 'ছট্' পুজোতেও তাই। ছট্-এ হয় সূর্যের পুজো। পক্ষান্তরে সূর্যের রশ্মির পুজো, 'রশ্মি' মানেই 'ছটা', 'ছটা' থেকে 'ছট্'। ছট্ বছরে দুবার হয়, কার্ত্তিক এবং চৈত্র মাসে। সূর্য হলেন প্রানের দেবতা। তাই ধারণা করা হয়, ছট্ পুজোর সূচনা হয়েছিল রুক্ষ্ম প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য সূর্যের উপাসনার মধ্য দিয়ে। কল্পনা করা যেতেই পারে যে, কার্ত্তিক মাসের পুজোর সময় বা উপাসনার সময় হয়তো প্রার্থনা করা হত এইভাবে : 'হে প্রভু, তোমার মিঠে রোদে ভুবন ভরিয়ে দাও, রুক্ষ্ম মাটির এই দেশে প্রবল শীত, আমরা দরিদ্র, উপযুক্ত শীতবস্ত্র আমাদের নেই, তোমার রশ্মিজালে সেই প্রবল শীত থেকে আমাদের রক্ষা করো, আমাদের ক্ষেতখামার সোনার ফসলে ভরিয়ে তোল।' আর চৈত্র মাসের পুজোয় হয়তো প্রার্থনা করা হত এই বলে যে : 'হে সূর্যদেব, আসন্ন বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যে তোমার প্রখর রশ্মিজাল স্নিগ্ধ রেখো, তাতেই রুক্ষ্ম মাটির মানুষ বেঁচে থাকবে নতুন আশায়, ফসল বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায়।' ধীরে ধীরে এই ধরণের প্রার্থনা থেকেই রূপ নিয়েছে আজকের ছট্ পুজো। 

বিহারিরা ছট্-কে 'ছট্ মাঈ কী পূজা'ও বলেন। কেন? বলছি। আসলে, সূর্যের পুজো করতে গিয়ে তাঁরা একদা কল্পনা করলেন যে, সূর্যদেবের কোমল নরম রশ্মিমালাই হলেন সূর্যদেবের স্ত্রী ঊষা। ফলে, এই পুজোয় তাঁরা সূর্যদেবের সঙ্গে উপাসনা করতে শুরু করলেন ঊষাদেবীরও। তাই, 'ছট্' শুধু পিতা হয়েই রইলেন না, হয়ে উঠলেন মাতাও।

লোক-ঐতিহ্য থেকে জন্ম নেওয়া 'ছট্' উৎসব পরবর্তীকালে পুরাণ-সংকলক ও সম্পাদকদের কলমকারিতে স্থান পেয়েছে 'রামায়ণ', 'মহাভারত' এবং অর্বাচীন পুরাণের প্রক্ষিপ্ত অংশে। পেয়েছে শাস্ত্রের সিলমোহর। হয়ে উঠেছে বৃহত্তর এক পার্বণ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...