বুংকেশ্বরী মন্দির, সিদ্ধ তান্ত্রিকের হাতেই পুজো নেন দেবী

কালীক্ষেত্র বীরভূমে রয়েছে মা বুংকেশ্বরীর মন্দির। অত্যন্ত জাগ্রত লৌকিক দেবী হলেন বুংকেশ্বরী। অনেক গবেষক বুংকেশ্বরী দেবীকে বৌদ্ধ দেবী বলে মনে করেন। বীরভূম জেলার রামপুরহাট থানার অন্তর্গত বুংকেশ্বরীতলায় দেবীর অধিষ্ঠান। রামপুরহাট স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে তিন কিলোমিটার মতো গেলেই দেবী বুংকেশ্বরীর মন্দিরের দেখা মিলবে। কিংবদন্তি অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদের নিমতিতার জমিদার চৌধুরীরা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দির তৈরির আগে দেবীর অধিষ্ঠান ছিল প্রাচীন নিম ও শেওড়া গাছের নীচে এক বেদীতে, যেমন থানে লৌকিক দেবদেবীরা বিরাজ করেন ঠিক তেমনই। দেবীর স্বপ্নাদেশে পরে পাকা মন্দিরটি নির্মিত হয়। একেবারে প্রথমে মন্দিরটি ছিল উত্তরমুখী। কিন্তু পুনরায় দেবীর স্বপ্নাদেশ পাওয়ায় মন্দিরটি দক্ষিণমুখী করে নির্মিত হয়। আজও মন্দিরটি দক্ষিণমুখী অবস্থাতেই বিদ্যমান। মন্দিরটি দেখে মনে হবে এখনও এটি অসমাপ্ত। একেবারে বাহুল্যবর্জিত মন্দির।

মন্দিরের দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে খাল, স্থানীয়দের মধ্যে খালটি কান্দর নামে পরিচিত। খালটিকে কেউ কেউ ত্রিবেণী বলেও ডাকেন। ত্রিবেণীর জল নীল এবং বেশ স্বচ্ছ। বহু প্রাচীন কয়েকটি শিমুল ও অন্যান্য গাছে ভরা জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে শ্মশান। শোনা যায়, প্রতি অমাবস্যায় মন্দির সংলগ্ন শ্মশানে অন্তত একটি হলেও মৃতদেহ সৎকারের জন্য আসবেই। যুগ যুগ ধরে এমনটা হয়ে আসছে। প্রায় বারো তেরো বিঘা জমির উপর মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরের পশ্চিমমুখে বামাক্ষ্যাপার সাধনার আসনটি আজও বিদ্যমান। এই আসনে বসেই তন্ত্রসাধনা করেছিলেন মহাসাধক বামদেব। তন্ত্রমতে দীক্ষা না হলে বুংকেশ্বরী মন্দিরে পৌরোহিত্য করা যায় না। জনশ্রুতি হল, এই মন্দিরে সাধারণ মানুষ রাত্রিযাপন করতে পারেন না। বিশেষ তিথিতে কৌল-তান্ত্রিকরা এসে এখানে নিশি পুজো করেন।

পয়লা মাঘ দেবীর বাৎসরিক পুজো হয়। দেবী বুংকেশ্বরীর নামে বুংকেশ্বরীতলায় দেবীর পুজো উপলক্ষ্যে মেলা হয়। প্রায় ৩০০ বছর ধরে এই মেলা চলে আসছে। আগে মেলা অনেকদিন ধরে চললেও, এখন একদিনের মেলা বসে। স্থানীয়দের কাছে বুংকেশ্বরীর মেলা ব্রহ্মদৈত্যর মেলা নামে পরিচিত। দেবীর পুজো হয় দিনের বেলায়। বছরের অন্যান্য দিন দেবীর নিত্যপুজো হয়। সাধারণত প্রতি অমাবস্যায় দেবী বুংকেশ্বরীর পুজো হয়। দিনের বেলাতেই দেবীর আরাধনা চলে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, দেবী বুংকেশ্বরী আদপে শিব-পার্বতীর মিলিত রূপ। প্রচলিত লোক বিশ্বাস অনুযায়ী, শিবের জটায় গঙ্গাকে অবস্থান করতে দেখে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন পার্বতী। তাঁকে শান্ত করার জন্যে পার্বতীর শরীরের সঙ্গে মিলিত হন মহেশ্বর। একাংশে বর্তমান থাকে শিবের উপস্থিতি, অন্য অংশে বিরাজ করেন নারী শক্তি পার্বতী। আর এই দূর্গা শিবের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় বুংকেশ্বরী দেবীর। তিনি শক্তির দেবী। ভক্তদের বিশ্বাস, শরীরের কোনও অংশ কেটে গেলে দেবীর কাছে প্রার্থনা জানালেই মনস্কামনা পূরণ হয় অর্থাৎ নিরাময় হয়। আরোগ্য লাভের পর ওই ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে মাথায় করে মাটি বয়ে নিয়ে এসে মন্দিরের সামনে রাখতে হয়।

মন্দির সংলগ্ন শ্মশান পুণ্যভূমি রূপে খ্যাতি লাভ করেছে, এখানে রানিগঞ্জ, মুঙ্গের, পাটনা থেকেও মৃতদেহ সৎকারের উদ্দেশ্যে আনা হয়। শ্মশানের চারদিকে রয়েছে অজস্র বেদি। আত্মীয়দের দাহ করার পর, অনেকেই এই বেদিগুলো তৈরি করিয়েছেন। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবী বুংকেশ্বরীর কাছে দুটি প্রাচীন সাপ রয়েছে। দেবীর বিগ্রহের সঙ্গেও দুটি সাপের মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের সবচেয়ে কাছাকাছি গ্রাম হল খড়বন। মন্দির থেকে তার দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার মতো। রামপুরহাট থানার পশ্চিমে অবস্থিত খড়বন গ্রামের উত্তরে বুমকদলা নামের এক জায়গায় দেবীর মন্দিরটি অবস্থিত। স্থানীয়দের বিশ্বাস, মন্দির সংলগ্ন ঝিলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত খাল কোনওদিন শুকিয়ে যায় না। গ্রীষ্মকালেও তাতে জল থাকে। এই খালই ত্রিবেণী নামে পরিচিত। এই খালের সামনের দিকটা দেখতে অনেকটা তিনটি বেণীর মতো। এই খালে নাকি গভীর খাদ রয়েছে। তাই কেউ খালে নামতে সাহস পান না।

দেবী বুংকেশ্বরীর সম্পূর্ণ মূর্তিটি পাথরের। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ক্যানেল ডিপার্টমেন্টের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার জনৈক হরেশ বন্দোপাধ্যায় মূর্তিটি প্রতিষ্ঠাতা করেছিলেন। মূর্তিটি আসলে মা কালীর। মাঘ মাসের প্রথম দিন এখানে জাঁকজমকপূর্নভাবে দেবীর পুজো হয়। মন্দিরে প্রথম থেকে বলি প্রথা না থাকলেও, পরবর্তীকালে বলির প্রচলন হয়। দেবীকে শক্তির দেবী বলে মনে ভক্তরা। দেবী মন্দিরের পাশাপাশি শ্মশানকালী, বিশালাক্ষী ও শিব মন্দির রয়েছে বুংকেশ্বরীতলায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...