চিরাচরিত রূপ ছাড়াও দেবী কালী বঙ্গে ব্যতিক্রমী রূপেও পূজিতা হন। হুগলি জেলার সিঙ্গুরের নান্দা সন্ন্যাসীঘাটায় রয়েছে ব্রহ্মময়ীর মন্দির, সে মন্দিরেও দেবীর এক ব্যতিক্রমী রূপের পুজো হয়। দেবীর মুখমণ্ডলের আকৃতি অপেক্ষাকৃত বড়, তিনি লোলজিহ্বা। ব্রহ্মময়ী চতুর্ভূজা, মুণ্ডমালা বিভূষিতা। দেবীর গাত্র বর্ণ নীল, পদতলে শ্বেতশুভ্র মহাদেব। গর্ভগৃহে রয়েছে মায়ের ভক্ত মৌনীবাবার পথিকৃতি, জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা, শালগ্রাম শিলা। মন্দিরের পাশেই রয়েছে শিব মন্দির। ব্রহ্মময়ীর মন্দিরের বয়স একশো বছরের বেশি। একদা সরস্বতী নদী প্রবাহিত হত মন্দিরের পাশ দিয়ে। এখন নদী মজে গিয়েছে, বর্ষায় জল থাকে কেবল। সরস্বতীর তট চিরকালই তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্র বলে প্রসিদ্ধ। পালযুগ থেকে সাধকেরা সরস্বতীর তীরে বাস করতেন এবং তন্ত্রচর্চা করতেন।
জঙ্গলাকীর্ণ এই স্থানে সাধনা করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, তিনিই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমান মন্দিরের পিছন দিকে ছিল তাঁর সাধনার স্থল। কথিত আছে, তিনি জঙ্গলে বাঘ মেরেছিলেন। সেই ব্যাঘ্র মণ্ড সহ পাঁচটি মণ্ড নিয়ে পঞ্চমণ্ডির আসন গড়ে পুজো করতেন তিনি। মায়ের এই রূপটিরই আরাধনা হত। তবে সে'সময়ের চেয়ে এখন মূর্তির আকার বড় হয়েছে। পরবর্তীতে তিনিই মহাসাধকে শ্রীশ্রীমৎ স্বামী ভুবনানন্দ সরস্বতী মহারাজ নামে পরিচিত হন। যদিও লোকে তাঁকে মৌনী বাবা বলেই বেশি চেনে। জনশ্রুতি রয়েছে, তিনি বারো বছরের জন্য মৌনব্রত নিয়েছিলেন। যেদিন তিনি মৌনব্রত ভাঙেন, সেদিন গোটা এলাকায় উৎসব পালিত হয়েছিল। দীর্ঘ তন্ত্র সাধনা করে তিনি মায়ের কৃপা পেয়েছিলেন। মন্দিরের পিছনে ছিল তাঁর ধুনী ঘর, সেখানে অহরাত্র আগুন জ্বলত। এখন প্রতি অমাবস্যায় ধুনী জ্বালানো হয়। মৃত্যুর পর সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
মন্দিরে রাসের মেলা পালিত হয় মহাধুমধাম সহকারে। মৌনি বাবার জন্ম ১৩১০ সনে, মৃত্যু ১৩৬৬ সনে। তাঁর তিরোধান দিবস পালিত হয় প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসের ২৫ তারিখ। তখন প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। মা ব্রহ্মময়ী মন্দিরটি বছর তিরিশেক আগেও টিনের চালা-মন্দির ছিল, একেবারে প্রথমে ছিল পর্ণকুটির। নান্দা এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষদের আর্থিক সহযোগিতায় পাকা মন্দির তৈরি হয়েছে।
শোনা যায়, পূর্বজীবনে মৌনীবাবা ছিলেন ডাক্তার। প্রতিদিন ডাক্তারি করতে যেতেন। এমনই একদিন তিনি ডাক্তারি করতে বেরিয়ে আর বাড়ি ফিরে এলেন না। কয়েক দিন পর স্থানীয় লোকজন দেখলেন ডাক্তারবাবু সরস্বতী নদীর তীরে জঙ্গলের মধ্যে ধ্যানে মগ্ন। রটে গেল ডাক্তারবাবু নিশ্চয়ই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, না-হলে গভীর জঙ্গলে জীবিত থাকা কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন মৌন থাকার কারণে লোকেরা তাকে মৌনীবাবা বলে ডাকতেন। তিনি আর সংসারে ফেরেননি। জঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে তোলেন এক আশ্রম। যা নান্দা সন্ন্যাসীঘাটা যতীন আশ্রম নামে পরিচিত। স্থাপন করেন দেবী কালিকার মন্দির। মন্দিরে দু-বেলা নিত্য পুজো হয়। প্রতিদিন মায়ের অন্ন ভোগ হয় তবে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। দেওয়া হয় ফল ও মিষ্টি। অমাবস্যা, পূর্ণিমায় নিবেদন করা হয় ময়দার খাদ্য সামগ্রী। দেবাদিদেবকেও নিত্য ভোগ নিবেদন করা হয় এখানে। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবী খুবই জাগ্রত এবং তিনি ভক্তদের মনোকামনা পূর্ণ করেন।