আজ কালী কথায় বর্ধমানের বড়বেলুনের কালীর কথা, এই কালী পুজোর বয়স ৬০০ বছর। আজ এই কালীপুজোয় হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। জানা যায়, সাধক ভৃগুরাম এই পুজোর সূচনা করেছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, প্রায় ৬০০ বছর আগে কেতুগ্রামের বহুলা পীঠ থেকে ভৃগুরাম বর্ধমানে গিয়েছিলেন। ভৃগুরাম ছিলেন অকৃতদার। তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়ে বড়বেলুন এলাকায় শ্মশানের পাশে পর্ণকুটিরে বসবাস শুরু করেন। সাধক ভৃগুরামকে বুড়োগোঁসাই নামে ডাকত স্থানীয়রা। শোনা যায়, দেবীই ভৃগুরামকে বিবাহ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
দেবীর আদেশ মেনে তিনি বিয়ে করেছিলেন। সেই বিয়ে নিয়েও রয়েছে জনশ্রসে। বিল্বপত্তনের রাজা নারায়ণচন্দ্র রায়ের কুমারী কন্যা সর্পাঘাতে মারা যান। সেই রাজকন্যার দেহ বড়বেলুনের শ্মশানে নিয়ে আসা হয় সৎকার করার জন্য। দেহটি শ্মশানে পৌঁছনোর পরেই আরম্ভ হয় তুমুল ঝড়বৃষ্টি। শবযাত্রীরা ঝড়ের কারণে শ্মশানে দেহ রেখে একটু দূরে আশ্রয় নেন। সেই সময় ভৃগুরাম মৃতদেহের ওপর শ্মশানের চিতাভষ্ম ছিটিয়ে দিতেই, বেঁচে ওঠেন রাজকন্যা। ঝড় থামতেই শববহনকারীরা ফিরে এসে দেখেন রাজকন্যা জীবিত। তবে বেঁচে ওঠা মেয়েকে আর তাঁর পরিবার এবং সমাজ ফিরিয়ে নিতে চায়নি। ওই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ভৃগুরাম স্বপ্নাদেশ পান। দেবীর আদেশ তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, দেবী সেই সময় বিশালাকায় রূপ ধারণ করে ভৃগুরামকে বিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই বড়বেলুন গ্রামে ১৮ হাত উচ্চতা বিশিষ্ট মূর্তি বানিয়ে পুজো করা আরম্ভ হয়। গ্রামবাসীরা বলেন, ৭০০ বছর আগে এক সাধক জনৈক ভৃগুরাম বিদ্যাবাগীশ পঞ্চমুণ্ডের আসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘বুড়ো গোঁসাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনিই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা। সারা বছর মন্দিরে কোনও বিগ্রহ থাকে না। লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে ৩০ ফুট উচ্চতার মূর্তি তৈরি হয়। পুজোর দিন দুপুরে দেবীকে রঙ করা হয়, সন্ধ্যায় নানা অলঙ্কারে সাজানো হয়।
গ্রামের নাম বড়বেলুন হয়েছে এই শ্মশান থেকেই, শ্মশানের পাশে ছিল বিল্ব অর্থাৎ বেল এবং বটের বন। কালে কালে সেই জনপদের নাম হয় বিল্বপত্তন। উচ্চারণের পার্থক্যে তার নাম হয় বেলুন। তারপর বড়বেলুন। পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের অন্যতম প্রাচীন গ্রাম বড়বেলুনের বড় মা অর্থাৎ মা কালীর পুজো এখন গোটা বাংলাতেই বিখ্যাত। ভৃগুরামের বংশধররাই একুশ পুরুষ ধরে পুজো করে আসছেন। শাক্তমতে পুজো হয় এখানে। বিশালাকার দেবীমূর্তিই এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ।
দুর্গাপুজোর পর ত্রয়োদশীর দিন বড় কালী মার প্রতিমার কাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৮ হাত উচ্চতার বড় কালীর জিভ তৈরি হয় নতুন কুলো কেটে। পুজোর দিন দুপুর থেকে মায়ের বিশালাকার মূর্তিতে রঙ করা হয়। সন্ধ্যায় ডাকের সাজে দেবীকে সাজানো হয়। রাতে মূর্তি গড়ার কাজ করার সময় মশালের আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। প্রায় ৮-৯ ঘন্টা চলে এই পর্ব। পুরোহিত এসে ভাড়ার উপরে উঠে মায়ের চক্ষুদান করেন। তারপর শুরু হয় পুজো। রাতভর চলে পুজো ও বলিদান পর্ব। পুজোয় লক্ষাধিক পুন্যার্থীর সমাগম হয়। দূর-দুরান্তের মানুষ কালীপুজোয় বড়বেলুন গ্রামে ভিড় জমান। বড়বেলুনের ভট্টাচার্য পরিবার এই পুজোর সেবায়ের। ৩৫ টি পরিবারের ট্রাস্ট পুজোর আয়োজন করে। মা বড়মা কালীর নির্দেশ ছিল ভৃগুরামের বংশধররা তাঁর নিত্যপুজো করবে, আর তার মাধ্যমেই দেবী চিরদিন তাঁর ঘরে বাঁধা হয়ে থাকবেন। ভৃগুরামের উত্তরসূরিরা আজও সূচনা সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। শোনা যায়, সাধক ভূগুরাম কোনও এক অমাবস্যার ভোরে কালীর পুজো পদ্ধতি তিন ছেলেকে শিখিয়ে দিয়েই দেহত্যাগ করেছিলেন।
দেবীর বিশাল প্রতিমা বিসর্জনের সময়, অন্নভোগের আয়োজনে লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করে। প্রাচীন রীতি মেনে আজও পুজো হয়। বড়মা কালীর পুজোয় আজও মহিষ বলির প্রথা চালু রয়েছে। কয়েকশো ছাগ বলি দেওয়া হয়। তিনদিন ধরে পুজো চলে। পুজোয় ভক্তদের জন্য থাকে অন্নভোগের আয়োজন। মেলা বসে। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই পুজো উপলক্ষ্যে আত্মীয় পরিজনদের ভিড় বাড়ে। দেবীকে রথে চাপিয়ে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ভাতৃদ্বিতীয়ায় ফোঁটা দিয়ে দেবীর বিসর্জন হয় বড়দিঘিতে।