কালী কথা: বিশ্বগয়া মা কালী বুড়ি মন্দির, যে মন্দিরে মুক্তি পায় অতৃপ্ত আত্মা

আজ কালী কথায় বিশ্বগয়া মা কালী বুড়ি মন্দিরের কথা বলব। এই মন্দির ঘিরে রয়েছে নানান ভয়াল-ভয়ঙ্কর কাহিনী। আসানসোলের কালীপাহাড়িতে রয়েছে বিশ্বগয়া কালীবুড়ি মন্দির। স্থানীয়দের বিশ্বাস দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। ভক্তদের কথায়, দেবী এখানে জীবন্ত। বিস্ময়, ভক্তি, বিশ্বাস আর অলৌকিক কাহিনীতে ঠাসা এই মন্দির। মন্দিরের নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে গয়ার কথা।

গয়ার মতো এখানেও অতৃপ্ত আত্মাদের পিণ্ডদান করে মুক্তি দেওয়া। কালীপুজোর সময়ে এক বিশেষ তিথিতে চলে পিণ্ডদান পর্ব। আসানসোলের কালীপাহাড়ির এই মন্দিরের কাছেই রয়েছে একটি কুয়ো, যা প্রেত কুয়ো নামে পরিচিত। বলা হয়, বন্দি থাকা ভূত, পিশাচদের নাকি কালী পুজোর কুম্ভযজ্ঞ তিথিতে মুক্তি দেওয়া হয়। বিশ্বগয়া মা কালীবুড়ি মন্দিরের তান্ত্রিকরা এমনই দাবি করেন। আজও, এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে; কালীপুজোর রাতে বিশ্বগয়া কালীবুড়ি মন্দিরের অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হতে কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় জমান। আসানসোলের কালীপাহাড়ি যেন গয়াক্ষেত্র হয়ে ওঠে।

মন্দিরের তান্ত্রিক, পুরোহিত এমনকি সাধারণ ভক্তদের সকলেরই দাবি, এই মন্দিরে কেবল মাত্র দেবীই জীবন্ত নন। মন্দিরের আশপাশে ঘোরাফেরা করে আত্মাও। মন্দির সংলগ্ন প্রেতকুয়োতেই তাদের অবস্থান। স্বভাবতই দিনের বেলায় আত্মাদের খালি চোখে দেখা যায় না বা উপস্থিতি অনুভব করা যায় না। কিন্তু রাত হলেই, শুরু হয় তাদের তান্ডব। রাতে মন্দিরে থাকলেই শোনা যায় আত্মাদের ডাক। তারা যেন নানা ভাষায় স্পষ্ট কথা বলে। কাউকে দেখা যায় না। কেবল মনে হয়, কিছুটা দূরে কেউ কেউ সাদা শাড়ি পরে ঘোরাফেরা করছে। সেখান থেকেই ভক্তদের ডাকে আত্মারা। বাঁচাও বাঁচাও বলে তীব্র চিৎকারও শুনেছেন কেউ কেউ। মানুষকেও সেই সব আত্মারা নাকি ডাকে। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে ভক্তদের দাবি এমনটাই। মন্দিরের পুরোহিতের দাবি, দেবীর বাৎসরিক পুজোর দিন প্রেতরা এখানকার কুয়ো থেকে মুক্তি পায়। প্রতি সপ্তাহে শনি এবং মঙ্গলবার ডাকিনী-যোগিনীর পুজো হয়। সেই সময় পাঁঠা বা মুরগির বলিদান দেওয়ার রীতি রয়েছে।

শোনা যায়, প্রতি অমাবস্যার রাতেই এই মন্দির চত্বর নাকি কিছুক্ষণের জন্য হলেও আলোকিত হয়ে যায়। বলা হয়, ইচ্ছাধারী নাগ আর নাগিনীর মাথায় লাগানো মণির জন্য এমনটা হয়। মণির আলোয় আলোকিত হয় মন্দির সংলগ্ন এলাকা। ভক্তদের দাবি, মন্দিরে সাদা, লাল ও কালো তিন ধরনের ইচ্ছাধারী নাগের দেখা মেলে। ওই তিন ইচ্ছাধারী নাগ নাকি আকৃতিতে অতিকায়, লম্বায় বেশ বড়, আর প্রস্থেও বিপুল। তাদের দেখলে মন্দিরের পুরোহিত থেকে শুরু করে ভক্তরা, সকলেই দূর থেকে প্রণাম করেন। আশেপাশে অসংখ্য সাপ থাকলেও মন্দিরের কারও কোনও ক্ষতি করে। আজ অবধি সাপগুলোর দংশনের কোনও খবর শোনা যায় না। দেবী সকলের মনোস্কামনা পূরণ করেন। অসুস্থতাজনিত রোগ নিরাময় থেকে যাবতীয় ইচ্ছাপূরণ, এলাকাবাসীর ভরসা এই মন্দির। আসানসোল কালীপাহাড়ি ওভারব্রিজের নীচে নেমে একটু হাঁটলেই সামনেই দেখা যায় বিশ্বগয়া মা কালী বুড়ি মন্দির। মন্দিরে যাতায়াত করা অত্যন্ত সহজ। মন্দিরে ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে।

কালীপুজোর আগের দিন অর্থাৎ ভূত চতুর্দশী তিথিতে নির্দিষ্ট সময়ে মন্দিরে ভূত প্রেতদের নিয়ে তন্ত্রমন্ত্রের চর্চা শুরু হয়। দুই নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে মন্দির চত্বরে থাকা কুয়োর মুখটি খাঁচাবন্দি। কুয়োর গায়ে লেখা প্রেত কুয়ো। সেখানেই ভূত প্রেতদের জাগানো হয়। বলির মাংস, নরমুণ্ডে শুরু হয় সাধনা। জেগে ওঠেন দেবী কালিকাও। মন্দিরের তান্ত্রিকদের দাবি, জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে বা স্থানীয় কারও অপঘাতে মৃত্যু হলে, সেই অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় এলাকায়। পথচলতি মানুষের উপর সেই আত্মা ভর করলে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই তাদের মন্ত্রবলে ওই কুয়োর মধ্যে আটকে রাখা হয়। কালীপুজোর সময় বিশেষ তিথি দেখে মহাকুম্ভ যজ্ঞা করা হয়। সেই যজ্ঞের পর কুয়োয় পিণ্ডদান করে প্রেতদের মুক্তি দেওয়া হয়। কালীপুজো মানেই শক্তির উপাসনা। কালী মূর্তির পাশেই দেখা যায় ডাকিনী, যোগিনী, ভূত, পিশাচদের। গা-ছমছমে অলৌকিক কাহিনীর টানে তথা ভক্তিতে, প্রতি বছর কালীপুজোয় বিশেষ তন্ত্রসাধনা দেখতে কালীপাহাড়ির বাসিন্দারা এখানে ভিড় করেন। দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসেন মন্দিরে। কথায় বলে না, বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। এও ঠিক তাই, বিশ্বাস আর ভক্তি পরতে পরতে মিশে গড়ে তুলেছে এই মন্দিরকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...