বীরভূমের আরও এক স্বল্পখ্যাত কালী পীঠের কথা আজকের কালী কথায়। সিউড়ী এক নম্বর ব্লকের অন্তর্গত খটঙ্গা পঞ্চায়েতের ভাণ্ডিরবন ধামের কাছেই রয়েছে এক গ্রাম, নাম বীরসিংহপুর। সেখানেই রয়েছে বহু প্রাচীন এক কালী মন্দির। দেবী মূর্তি বেশ ভয়ঙ্করী, সম্পূর্ণ পাথর নির্মিত মূর্তি। মূর্তির বয়স প্রায় সাড়ে আটশো বছর। রাজা বীর সিংহের নামেই গ্রামের নাম হয় বীরসিংহপুর। এই গ্রামেই তিনি স্থাপন করেন রাজধানী, প্রতিষ্ঠিত হন মা কালী। আজ আর কিছুর চিহ্ন নেই। তবে দেবী কালীর মূর্তি রয়ে গিয়েছে। নতুন করে তৈরি মন্দিরটিও রয়েছে। পুরনো মন্দিরের পিছনে তৈরি হয়েছে নতুন বর্তমান মন্দির। বলা হয়, বীরসিংহপুরের দেবী কালীরা সাত বোন। মগধেশ্বরী কালী হলেন মেজ বোন। পাঠানদের অত্যাচারে রাজনগর থেকে বীরসিংহপুরে চলে আসেন মা। বহু বছর আগে মন্দিরের আশপাশে তাঁতিদের বসবাস ছিল। সারা রাত তাঁতিরা তাঁত চালিয়ে কাপড় বুনতেন। তাঁত বোনার খটখট আওয়াজে মা খুব অসন্তুষ্ট হন। স্বপ্নাদেশে তাঁতিদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলেন। তাঁতিরা স্বপ্নাদেশ পেয়ে বীরসিংহপুর ছেড়ে চলে যায়।
বীরসিংহপুর শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যশালী গ্রাম। দ্বাদশ শতকে রাজা বীর সিংহের রাজধানী ছিল বীরসিংহপুর। মন্দির প্রাঙ্গণে আজও তদানিন্তন রাজধানীর ভগ্নাদেশের নিদর্শন দেখা যায়। বীরসিংহপুরেই বিরাজ করছেন মগধেশ্বরী কালী। কালী ছিলেন বীর সিংহের আরাধ্যা। কেউ কেউ বলেন, ছ'শো বছরেরও বেশি সময় ধরে পূজিতা হয়ে আসছেন মগধেশ্বরী কালী মা। পুজোকে ঘিরে বহু, জনশ্রুতি, লোককথা শোনা যায়। জানা যায়, মগধরাজ জরাসন্ধের বংশোদ্ভূত বীর সিংহ ভাগ্য অন্বেষণে বঙ্গদেশে এসেছিলেন। তিনিই বীরসিংহপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। যদিও তখনও বীরসিংহপুর নাম হয়নি।
রাজা বীর সিংহ বাংলায় আসার সময় তাঁদের কূলদেবী কালীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কালী ভক্ত ছিলেন। মন্দিরে নিত্য পুজো পেতেন কালী, বিশেষ বিশেষ দিনে ধুমধাম করে পুজো হত। নানান ধরনের অনুষ্ঠান করতেন রাজা বীর সিংহ। ১২২৬ সালে বাংলার সুবেদার গিয়াসউদ্দিন বলবন বীরসিংহপুর আক্রমণ করেন, সেই যুদ্ধে বীর সিংহ পরাজিত ও নিহত হন। বীর রাজার বংশধররা বীরসিংহপুর থেকে রাজনগরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। কূলদেবী কালীকেও নিয়ে যান তারা। রাজনগরে কালীদহ পুকুরের উত্তর দিকে দক্ষিণমুখী এক বিশালাকার মন্দিরে কূলদেবী কালীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৬০০ সালে পাঠানদের আক্রমণে বীর রাজাদের পতন ঘটে।
জনশ্রুতি রয়েছে, কালীদহের জল অপবিত্র হওয়ায় মা আর রাজনগরে থাকতে চাননি। সে কারণেই কুশকরণীর নদীর জলে ভাসতে ভাসতে খটঙ্গা গ্রামে কাছে আটকে যান দেবী। পর দিন সকালে জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে কালী মূর্তিটি পায়। জেলে ও স্থানীয় ভক্তরা কালী মূর্তিটি বীরসিংহপুরে বীর রাজার কালী মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে। পরে রাজনগরের রাজা আসাদুজ্জামানের দেওয়ান রামনাথ ভাদুড়ী মন্দিরটি নির্মাণ করেন এবং নিত্য ব্যবস্থা করেন। মগধ থেকে মাকে আনা হয়েছিল বলেই দেবী, মগধেশ্বরী কালী নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। আজও কষ্টি পাথরের মূর্তিতে মা কালী সারা বছর ধরে পুজো পান। দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে কালী পুজো উপলক্ষ্যে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। মন্দিরের দেবী খুব জাগ্রত দেবী। মনোস্কামনা পূরণের জন্য মায়ের কাছে বহু ভক্ত ধর্না দেন। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা কালী মন্দিরে আসেন পুজো দিতে।