চলছে বিপত্তারিণী পুজো। বাংলায় ব্রত-পার্বনের অভাব নেই। মা ঠাকুমারা সংসারকে বিপদ মুক্ত রাখতে ব্রতটি পালন করে থাকেন। রথ ও উল্টোরথের মাঝে শনি ও মঙ্গলবার মা বিপত্তারিণীর পুজো হয়। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, মা বিপত্তারিণী সংসারের সমস্ত বিপদ হরণ করেন। মল্লভূমের ইতিহাসে জড়িয়ে রয়েছে এই পুজোর কথা। সপ্তম শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মল্লরাজারা একটানা বিষ্ণুপুর শাসন করেছিল। সেই মল্ল রাজবংশেরই এক রাজার পত্নী ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ৷ এক মুচি পত্নীর সঙ্গে তাঁর ভীষণ সখ্যতা ছিল। সেই মুচিরা গোমাংস খেতেন৷ একদিন রানির ভীষণ কৌতূহল হল, গোমাংস কেমন তা তিনি নিজে দেখবেন। মুচির স্ত্রীর কাছে রানী একথা জানাতেই সে ভয়ে কাঁটা। মহারাজ পরম ধার্মিক শুদ্ধাচারী, তিনি যদি জানতে পারেন, তবে মুচির মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। কিন্তু তৎসত্ত্বেও রানি খুবই জোড় করায় মুচি পত্নী রাজি হল।
একদিন সে যত্নসহকারে গোমাংস রেঁধে লুকিয়ে রাজবাড়িতে রানিমাকে দিয়ে গেল। রানি তো গোমাংস মুখেও তুলবেন না, শুধু দেখবেন। রাজার কানে পৌঁছে গেল এই কথা। কোন এক রাজকর্মচারীর মুখে একথা শুনে ক্রোধে রাজা অন্দরমহলে এলেন। রানি ভয়েই কাতর। কীভাবে গো মাংস লুকাবেন ভেবে পাচ্ছেন না। নিরুপায় হয়ে আঁচলের তলায় মাংসের পাত্র লুকিয়ে ফেললেন৷ বিপদ মুক্ত করার জন্য চোখ বুঝে মা দুর্গাকে ডাকতে লাগলেন। মা দুর্গা ডাক শুনলেন।
রাজা ঘরে এসে রানির আঁচল টেনে ছিঁড়ে দিতেই, আঁচলের নীচ থেকে বেরিয়ে এল একথালা রক্তজবা ফুল৷ শরণাগতবৎসলা মা তখন আবির্ভূত হয়ে রানিকে কানে কানে বললেন "ভয় নাই, আমি নিষিদ্ধ মাংসকে পুষ্পে পরিণত করিয়াছি।" এমন কাণ্ড করার জন্য অনুতপ্ত রাজা রানির কাছে ক্ষমা চাইলেন৷ এরপর থেকেই মা বিপত্তারিণীর আরাধনার প্রচলন হল।
বিপত্তারিণী অর্থাৎ যিনি বিপদ থেকে রক্ষা করেন। বাংলা এই পুজো ব্রত জনপ্রিয়। আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া থেকে শুক্লা দশমীর মধ্যে মঙ্গলবার এবং শনিবার সাধারণত এই পুজো হয়ে থাকে। লক্ষণীয় আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া অর্থাৎ রথযাত্রা এবং শুক্লা দশমী অর্থাৎ উল্টোরথের মধ্যে এই পুজো হয়। বিপত্তারিণীর আসলে দেবী দুর্গারই এক রূপ। মূলত মহিলারা ওই দিন উপবাসে থেকে দেবীর পুজো অর্চনা করেন। মনষ্কামনা করে হাতে লাল সুতো পরেন। অনেকে আবার মনষ্কামনা পূর্ণ হলে দণ্ডিও কাটেন। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় নদী বা কোন জলাশয়ে স্নান সেরে দণ্ডি কেটে পুজোর জায়গায় গিয়ে পুজো দেন। অনেকেই মনে করেন মা বিপত্তারিণী আসলে বাংলার এক লৌকিক দেবী। তবে মার্কণ্ডেয় মুনি প্রথম বিপত্তারিণী ব্রত কথা প্রচার করেন।
তন্ত্রে দেবীর উল্লেখ রয়েছে। 'বিপত্তারিণী কথামৃতম' বা 'তারিণ্যুপনিষদ' নামে এক তন্ত্রগ্রন্থের হদিশ পাওয়া যায়, যার রচয়িতা জনৈক জনার্দন ঠাকুর। জনার্দন নিজেকে রামরাম ঠাকুরের বংশধর বলে বর্ণনা করেছেন। এই গ্রন্থে জনার্দন লিখেছেন, তাঁর মা হরিপ্রিয়া এই দেবীর কৃপা লাভ করেছিলেন। এ ছাড়াও 'বিপত্তারিণীতন্ত্রম' নামে আরও একটি পুথির খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু এই গ্রন্থগুলি ঠিক কোন সময়ে রচিত, তা জানা যায় না। দেবী বিপত্তারিণীর রূপের সঙ্গে দেবী সংকটতারিণী বা মাতা সংকটার সাদৃশ্য রয়েছে। কোথাও তিনি শঙ্খ, চক্র, শূল ও অসিহস্তা স্বর্ণবর্ণা ত্রিনয়না, কোথাও আবার খড়গ, শূল, বরাভয়দায়িণী ঘোরকৃষ্ণা। বিপত্তারিণীর পুজো করলে সমস্ত বিপদ থেকে মুক্ত পাওয়া যায়, এমনটাই বিশ্বাস মানুষের।
বিপত্তারিণীর ব্রতকথায় দুই রাজপরিবারের কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। বিদর্ভের রাজা সত্যদাসের পুত্র ছিলেন অলোকেশ একবার মৃগয়া করতে বেরিয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে পাশের রাজ্য অবন্তীপুরে ঢুকে পড়েন। সে জায়গাটি ছিল অবন্তী রাজের মৃগয়া ক্ষেত্র। সেখানে একটি হরিণ শিকার করলে রাজার সেনারা তাকে বেঁধে নিয়ে যায় রাজ দরবারে। সে সময় অবন্তী রাজ্যের রাজা ছিলেন চক্রধর। বিদর্ভে সেই খবর পৌঁছলে বিদর্ভরাজ সত্যদাস অবন্তী রাজ্যের দরবারে ছুটে আসেন। অবন্তীরাজ তাকেও বন্দি করেন। রাজা এবং রাজপুত্রের বন্দি হওয়ার খবর পেয়ে বিদর্ভের রানি রত্না কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এরপর রানি সেই অবস্থায় উঠে পুজোর আয়োজন করলেন। সেই দিনটা ছিল রথ যাত্রার পরের মঙ্গলবার। রানি পুজো সেরে ভক্তিভরে দেবীর স্তব করতে লাগলেন।
শোনা যায় পুজো শেষে সংকল্প করলেন মায়ের কৃপায় তার স্বামী পুত্র মুক্ত না হলে, তিনি দেহ ত্যাগ করবেন। প্রার্থনা শুনলেন মা বিপত্তারিণীর। সেই রাতেই দেবী অবন্তীরাজ চক্রধরকে স্বপ্নাদেশে বললেন, আমার ভক্তকে তুমি বন্দি করে রেখেছে দেখে আমি কষ্ট পাচ্ছি।
স্বপ্নাদেশ পেয়েই অবন্তীরাজ তৎক্ষনাৎ বিদর্ভরাজ এবং তাঁর ছেলেকে মুক্তি দিলেন। সত্যদাসের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। দুই রাজ্য আত্মীয়তায় বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়ল। শান্তি ফিরল রাজ্যে। এই ব্রত কথা স্মরণ করে আজও বাংলার ঘরে ঘরে মহিলারা সংসারের বিপদ কাটাতে ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে দেবী বিপত্তারিণীর পুজো করে থাকেন।
প্রভু জগন্নাথ এখন মাসির বাড়িতে, উল্টো রথের দিন বাড়ি ফিরবেন। জগন্নাথদেবের রথ থেকে উলটো রথযাত্রার মধ্যে বিপত্তারিণী দেবী চণ্ডীর আরাধনায় সকলে ব্রতী হন। ভগবান কৃষ্ণই প্রভু জগন্নাথ, আর সকল দৈবীরূপী শক্তিময়ী দেবী চণ্ডীর হাতে অসুর, দৈত্য, দানবের বিনাশ হয়। নারদীয় পুরাণে তাই বিষ্ণুকে সর্বশক্তিমান এবং দুর্গাকে সর্বশক্তিময়ী বলা হয়েছে। বৈদিক যুগে এই রথের সময়েই ভগবান বিষ্ণু ও গৌরীর পুজো প্রচলিত ছিল। ঐতিহ্য মেনে রথের পরেই বিপত্তারিণী চণ্ডীর পুজো চলে আসছে। মহাভারতে যুদ্ধের পূর্বে পাণ্ডবদের বিপদ নাশ ও নিজের বৈধব্য প্রতিরোধের জন্য দ্রৌপদী গৌরীর আরাধনা করেছিলেন এবং যুদ্ধ শেষে স্বামীর জীবন রক্ষায় তাঁদের হাতে ১৩টি লাল সুতো বেঁধে দিয়েছিলেন।
তাই আজও বিপত্তারিণী পুজো শেষে রক্ত সূত্রের ত্রয়োদশ গ্রন্থিযুক্ত ডোর ধারণ করা হয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণে বিপত্তারিণী পুজোর বিধান রয়েছে। পুজোয় ১৩টি ফল, ১৩টি ফুল, ১৩টি পান সুপারি ও ১৩টি নৈবেদ্য দানের কথা বলা হয়েছে। সারা বছর বিপদ আপদ থেকে মুক্তি পেতে ১৩টি উপাচারে নৈবেদ্য সাজিয়ে মায়ের আরাধনায় সকলে ব্রতী হন।