কালী কথা: বিকট কালী

দেবী কালী হলেন বিকট-দশনা, উলঙ্গিনী, প্রলয়ঙ্করী শ্যামা। কালীর দেবীরূপের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গেলে একাধিক রূপের দেখা মেলে। স্মরণাতীত কাল থেকেই কালী নানান রূপে পূজিতা হচ্ছেন। উত্তরবঙ্গে তিনি পূজিতা হন তেমনই এক বিশেষ রূপে, যার নাম বিকট কালী। মা এখানে ভয়ঙ্করী। বিকট তাঁর রূপ। দেবী আবার দাপট কালী নামেও পরিচিতা। শক্তির আরাধ্য দেবী কালীর উগ্র ও ভয়ংকর রূপ সৃষ্টির পিছনে রয়েছে পৌরাণিক কারণ। প্রতি বছর চৈত্র মাসের শেষ দিনে দেবী বিকট কালীর পুজো হয়। চৈত্র সংক্রান্তি থেকে দো'সরা বৈশাখ অবধি বিকট কালীর পুজো উপলক্ষ্যে মেলাও বসে। মা বিকট কালীর মন্দির রয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলিতে। ত্রিমোহনীর মন্দিরের দেবী কালিকাকে কেউ কেই বিকটেশ্বরীও বলেন। বাৎসরিক পুজোর সময় দেশ, বিদেশ, পড়শী রাজ্য থেকেও আসেন ভক্তেরা। মন্দিরটি সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশ থেকেও ভক্তরা এখানে আসেন। 

 

কেউ কেউ বলেন, পুজোর বয়স দাঁড়ায় পাঁচশো বছরেরও বেশি। প্রাচীন বঙ্গে দেবীর পুজো আরম্ভ হয়েছিল। সময়কাল নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। বাংলার পাল ও সেন আমল থেকে পূজিতা হচ্ছেন দেবী কালিকা। সেক্ষেত্রে বিকট কালীর পুজোর বয়স কমপক্ষে হাজার বছরের বেশি। দেবী মাতা ঠাকুরাণী হিসাবেও ভক্তদের পুজো পান। মন্দিরে কোনও মাতৃমূর্তি নেই। দারু নির্মিত মায়ের মুখোশের পুজো হয়। কেবল সেখানে মুখমণ্ডল-ই পূজিত হয়। মুখোশের চোখ দুটি বিস্ফারিত। লোল জিহ্বা, পাশে দুটি কৃন্তক দাঁত দেখা যায়। মুখের বর্ণ একেবারে ঘন কালো। মুখোশটি কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল বলে জানা যায়। চামুণ্ডা মায়ের মুখোশ পরে ভক্তেরা পাড়ায় পাড়ায় দল বের করেন। পুজোর আগ থেকে পাঁচদিন ধরে নিরামিষ আহার করেন। পৈতে অর্থাৎ উপবীত ধারণ করেন। নিজেদের চুল কেটে দেবীকে অর্পণ করেন।

 

দেবী লৌকিক, দেবী চামুণ্ডা হিসাবেও পূজিতা হন মা  বিকট কালী। সারা বছর মন্দিরে মা নিত্যপুজো পান। গর্ভগৃহে শিব ও দেবী বিকট কালী একই সঙ্গে পূজিত হন। বাৎসরিক পুজো হয় চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে। সংক্রান্তির নয় দিন আগ থেকে শুরু হয় পুজোর প্রস্তুতি। মায়ের মহাস্নান হয়। সংক্রান্তির পাঁচ দিন আগে মায়ের ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়। লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়। বাৎসরিক পুজো উপলক্ষ্যে তিন দিন ধরে চলে মেলা। মন্দিরের পাশেই রয়েছে সুবিশাল দীঘি। 

 

বিকট কালীর পুজো ও তাকে ঘিরে চলা উৎসবের মূল আকর্ষণ হল দেবী বিকট কালীর মুখোশ পরে বিশেষ নাচ। একে লৌকিক নৃত্যের ঘরানায় ফেলা যায়। যা চামুণ্ডা নাচ নামে পরিচিত। নৃত্যশিল্পীরা মা বিকট কালীর মুখোশ পরে নেন এবং নাচতে আরম্ভ করেন। নৃত্যে সামিল হন হাজার হাজার ভক্ত। নাচ দেখতেও আসেন প্রচুর মানুষ। মশাল নিয়ে গোটা এলাকা ঘোরা হয়। মন্দির চত্বরে মশাল জ্বালা হয়। মায়ের মন্দিরের সামনে মশাল নিয়ে প্রদক্ষিণ করা হয়। লাঠি খেলা হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে নতুন বাঁশের ডালায় করে মাকে ভোগ নিবেদন করা হয়। প্রায় হাজার দশেক ভক্ত বাঁশের ডালায় ভোগ নিয়ে হাজির হন মায়ের সামনে। মহিলারা চুলে আলতা, সিঁদুর এবং গোবর জল মাখিয়ে দেবীর কাছে অর্পণ করেন। এই মন্দিরে এখনও বলিদানের রীতি আছে। 

 

মূল মন্দির ছাড়াও রয়েছে ছোট ছোট মন্দির রয়েছে প্রাঙ্গণে। প্রায় আটটি মন্দিরে এই অঞ্চলে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার হাওয়া শিলাখণ্ডগুলো ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো করা হয়। শিলাখণ্ডগুলোয় তেল ও সিঁদুর মাখানো হয়। এদের কোনওটির নাম শুর কালী, কোনওটি বাঘা কালী, কোনওটি বাসলী কালী। ভক্তদের বিশ্বাস মা মানত পূরণ হয়। সে বিশ্বাস নিয়ে লক্ষ লক্ষ ভক্ত ফি বছর পুজো দিতে আসেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...