আজ কালীকথায় এক ডাকাতে কালীর কথা। বাংলার বহু কালী মন্দিরের সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছে কোনও না কোনও ডাকাত। তেমনই একটি মন্দির রায়বাঘিনী ভবশঙ্করী দেবীর ডাকাতে কালী মন্দির। হুগলির তারকেশ্বর থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার। জাঙ্গিপাড়ায় রয়েছে দিলাকাশ, তার অনতিদূরে খুঁড়িগাছি গ্রামে রয়েছে মন্দির। প্রাচীনকালে এই অঞ্চল ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। এখানকার শাসকেরা ছিলেন অনার্য সর্দার ও নিম্নবর্গীয় হিন্দু। চণ্ডাল রাজা শনিভাঙ্গর ছিলেন এই জনপদের শাসক, বলা ভাল সর্বশেষ শাসক। তাঁর শাসনামলে, তাঁর অনুচরেরা লুন্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে। গোটা গ্রাম জুড়ে ত্রাসের সঞ্চার হয়। লুঠ শুরু করার আগে তারা দেবী কালীর সামনে নরবলি দিত। সেই কারণেই গ্রামে তারা ভীষণাকৃতি কালী মূর্তির প্রতিষ্ঠা করে। সেই কালীই আজ ডাকাতে কালী নামে খ্যাত।
বাগদী রাজা শনিভাঙ্গরের অত্যাচার ক্রমেই বাড়তে থাকে। এক সময় তা সীমা পেরিয়ে যায়। প্রজাদের মধ্যেও দেখা দেয় অসন্তোষ। শনিভাঙ্গরের পালিত পুত্র চতুরানন প্রজাদের এক বাগদী রাজাকে হত্যা করে। রাজা হন চতুরানন, এলাকায় শান্তি ফেরে। বন জঙ্গল সাফ করে প্রজাদের মধ্যে জমি ভাগ করে দেন চতুরানন। তারপর তাদের চাষবাসে উৎসাহ দিতে লাগলেন রাজা। চতুরাননের মৃত্যুর পর তার বংশের এক রানী ভবশঙ্করী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শাসনভার চালাতে থাকেন। রানীর বীরত্বের কথা গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। দিল্লির মসনদে তখন আকবর। মানসিংহের মারফত আকবর রানী ভবশঙ্করীকে মহারানী রায়বাঘিনী উপাধিতে ভূষিত করেন।
এই খুঁড়িগাছি গ্রাম রানী ভবশঙ্করী রাজত্বের অধীনে ছিল। তিনি ডাকাতে কালী মন্দিরকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেন। শোনা যায়, রানীর আমল থেকেই নরবলি বন্ধ হয়। এখন সারা বছর নিত্য পুজো হয়। চৈত্র মাসের অমাবস্যায় দেবীর বার্ষিক পুজো হয়। চক্রবর্তী ব্রাহ্মণরা প্রায় চার পুরুষ ধরে মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
এই মন্দিরের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেল ডাকাতদের কাহিনি? কী বলছে জনশ্রুতি?
খুঁড়িগাছিতে একদা মানুষের তেমন যাতায়াত ছিল না। ফলে ঘাঁটি গড়ে ছিল একদল ডাকাত। দলের সর্দার গাঙ্গুলি ব্রাহ্মণ ছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, গাঙ্গুলি ডাকাত একদা বর্ধমানের মহারাজার বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু আট-দশ বছর বয়সী এক মেয়ের কাছে বাধা পেয়ে আর ডাকাতি করা হয় না তাদের। দলের অন্য সদস্যরা মেয়েটিকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সর্দার মারতে দেননি। ডাকাতি করতে না পারলেও সর্দার একটা কালী মূর্তি চুরি করে নিয়ে চলে আসেন। এসে খুঁড়িগাছিতে সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। দিলাকাশের সেই জায়গাটি গির্জাতলা নামে পরিচিত। মূর্তি যেখানে প্রথম স্থাপিত হয়েছিল, সেই জায়গাটি নাকি একটি ঢিবির মতো ছিল। তার উপরেই মূর্তি স্থাপিত হয়। মূর্তি চুরি হওয়ায় বর্ধমানের রাজা খোঁজ করতে শুরু করেন। একদিন স্বপ্নাদেশ পান রাজা। স্বপ্নে দেবী জানান, তিনি খুঁড়িগাছিতে রয়েছেন। আর ফিরতে চান না। সেই মন্দির ভবশঙ্করী তৈরি করে দেন। মন্দিরের ফলকে লেখা রয়েছে,
‘শ্রী কালী ত্রিসপ্তাষ্টেন্দু শাকেহত্র মীনে
ভানৌ মিতে কুজে।
খুঁড়িগাছীতি পল্লীস্থৈশ্চিন্ময়ী
স্থাপিতা মঠে।।’
ফলকের নীচে লেখা, ‘বীরাঙ্গনা রানী রায়বাঘিনী প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস প্রসিদ্ধ শ্রী শ্রী ঈশ্বর ডাকাতে কালী মন্দির খুঁড়িগাছি, হুগলি’। তবে নির্দিষ্ট ক্ষণ জানা যায় না।
মন্দির চত্বরের খানিক দূরেই রয়েছে, লীলাবতীর থান, শিবমন্দির, মহাপ্রভু মন্দির। ওই এলাকায় এক সময় শ্মশান ছিল। দেবী শ্মশান কালী হিসেবেই পরিচিতা ছিলেন। দেবীকে চামুণ্ডা রূপে পুজো করা হত। মন্দিরের পূর্বতন দলিলে সেবায়েত হিসেবে জনৈক মনোহর রায়ের নাম রয়েছে। মন্দিরের দেবী কালী হলেও, এক কাঠামোতে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, জয়া-বিজয়া, ডাকিনী-যোগিনী থাকেন। খুঁড়িগাছির ডাকাত কালীর পদতলে থাকেন শিব। বর্তমান মন্দিরটি নবরত্ন স্থাপত্য রীতিতে তৈরি।