সুবে বাংলা ছিল প্রাক ব্রিটিশ আমলের সমৃদ্ধতম অঞ্চল, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা এবং বাংলার মধ্যে ঢাকা ও মুর্শিদাবাদ সবচেয়ে বিত্তশালী এলাকা। শিল্পেও পিছিয়ে ছিল না এই দুটি জনপদ। বয়ন শিল্পে মুর্শিদাবাদকে দেশের অন্যতম সেরা বলা চলে। সেখানেই জন্ম হয়েছিল বাংলার মসলিনের। যার খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া। সে মসলিন আবার হারিয়েও গিয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধের পর শুরু হয় পতন, তারপর স্বাধীনতা সংগ্রামও জড়িয়ে যায় মসলিনের সঙ্গে। কিন্তু কালের নিয়মে মসলিনের হৃতগৌরব ফিরে এসেছে। জিআই স্বত্ব পেয়েছে 'বাংলার মসলিন'।
বাংলার মসলিন বিখ্যাত তার সূক্ষ্ম বুনোটের কারণে, একটি আংটির মধ্যে দিয়ে গোটা কাপড় চলে যেত। আবার ছোট্ট দেশলাই বাক্সের মধ্যে রাখা যেত মসলিন। শীতকালে সন্ধেবেলা ঘাসের উপর বিছানো থাকলে, কাপড় শিশিরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেত। আদপে মসলিন অতি মিহি ও সূক্ষ্ম কাপড়। টাইগ্রিস নদীর তীরে মসূল নামে এক স্থানে এরকম সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি হত।
'মসূল' থেকে মসলিনের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। এর প্রাচীন নাম গঙ্গাপট্টাহি। অন্যমতে, দক্ষিণ ভারতের মসলিপট্টমে ইউরোপে বাণিজ্য ঘাঁটি ছিল তা থেকেই ‘মসলিন’ শব্দটির জন্ম। ভিনদেশি বণিকরা বাংলার মসলিনকে 'গোসামা অব দি ইস্ট', 'দি স্কিন অব দ্য মুন' প্রভৃতি নামেও ডাকত।
মসলিন ছিল রাজা-মহারাজাদের পোশাক। মোঘলদের ভারী পছন্দের ছিল মসলিন, বাংলার মসলিনকে তাঁরা 'মল মল' বলে ডাকত। মসলিনের সঙ্গে মিশে আছে স্বাধীনতার লড়াই। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতের মসলিন শিল্পীরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। বাংলার মসলিনের কদর ছিল গোটা পৃথিবীতে। শিল্পীরা দুধে ভাতেই ছিলেন, নানান জায়গা থেকে কাপড়ের বরাত আসত। পলাশীর যুদ্ধের পর বদলে গেল মসলিন শিল্পীদের জীবন। ব্রিটিশের অত্যাচারে পেশা পাল্টে ফেলেছিলেন বয়নশিল্পীরা।
নবাবি আমলে বাংলার মসলিন শিল্পীরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতেন। শাসক বদলাতে, ব্রিটিশ আমলে কোম্পানির কর্মীরা অত্যাচার আরম্ভ করে। দাদন প্রথা চালু হয়। অগ্রিম দিয়ে কম দামে মসলিন বুনিয়ে, সেগুলো চড়া দামে বিক্রি করা শুরু হয়। কোম্পানির লোকজন নামমাত্র দামে কারিগরদের কাছ থেকে মসলিন কিনতেন। রীতিমতো কর্মীদের বলপূর্বক বাধ্য করা হত। বাংলার শিল্পীদের কার্যত দাস বানিয়ে কাজ করানো হত। শোনা যায়, শিল্পীরা কাপড় বুনবেন না বলে নিজেদের আঙুল পর্যন্ত কেটে ফেলতেন। কেউ কেউ সামিল হয়েছিলেন বিদ্রোহে, সশস্ত্র বিপ্লবে নেমেছিলেন। তন্তুবায়দের অনেকেই সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন। গোটা সুবে বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল বিদ্রোহ। শান্তিপুরের তন্তুবায়দের আন্দোলন চরমে পৌঁছেছিল। ব্রিটিশ সরকার দমন, পীড়ন করে আন্দোলন থামায়। কিন্তু তাঁতিদের লড়াইয়ের জেরে কিছুটা হলেও রক্ষা পায় মসলিন। ফের উত্থান শুরু হয়। একুশ শতকে এসে জিআই প্রাপ্তিতে বাংলার মসলিন যেন বয়নশিল্পের ফিনিক্স পাখি হয়ে উঠেছে।