আজকের কালী কথায় বর্ধমানের রাজ পরিবারের কালীর কথা উঠে আসবে। বর্ধমান জেলার সঙ্গে কালী ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। অম্বিকা কালনার কালী মন্দির, কমলাকান্তের কালী গুনে ইয়ত্তা করা যাবে না। বর্ধমান বলতেই মনে পড়ে রাজ পরিবারের কথা, সেই রাজ পরিবারের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে রয়েছে সোনার কালীবাড়ি। তবে সোনার কালী মন্দিরে, আজ আর সোনার কালী প্রতিমা বিরাজ করেন না। কালীবাড়ির বর্তমান কালী প্রতিমাটি অষ্টধাতুর নির্মিত। বিশাল সিংহাসনের উপর দেবী কালিকা অধিষ্ঠান করেন। ১৮৯৯ সালে মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল, অর্থাৎ মন্দিরের বয়স একশো পঁচিশ ছুঁইছুঁই। বর্ধমান রাজ মহতাব চাঁদের আমলে তৈরি হয়েছিল মন্দিরটি।
জনশ্রুতি রয়েছে, এই মন্দিরে প্রথমে সোনার তৈরি কালী প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত ছিল। গত শতকের সাতের দশকে দেবী কালিকার সোনার মূর্তিটি চুরি যায়। পরবর্তী সময়ে অষ্টধাতুর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময় স্থানীয়রাই ছিলেন প্রধান উদ্যোগী। রাজা মহতাব চাঁদের সহধর্মীনি নারায়ণী দেবী ছিলেন, ভক্তিমতি মহিলা, পরম ধার্মিক। তিনি তন্ত্রসাধনায় বিশ্বাসী ছিলেন। শোনা যায়, ধর্মপ্রাণা স্ত্রীর মন রাখতেই রাজবাড়ির মিঠাপুকুর এলাকায় রাজা ভুবনেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেই ভুবনেশ্বরী মন্দিরেরই নাম হয় সোনার কালীবাড়ি। দেবীর ভক্তরা দেবীকে সোনার কালী বলেই ডাকেন।
এই মন্দিরের দেবী কালিকা করালবদনা নন, দেবীর মুখে রয়েছে প্রশান্তি, প্রশস্তি। দেবী লোল জ্বিহা নন। সাধারণ কালী বিগ্রহের সঙ্গে মন্দিরের কালী মূর্তির কোনও মিলই নেই। দেবীর পদতলে দেবাদিদেব শিব বিরাজ করেন না। সোনার কালী পুজোয় বাজানো হয় প্রকাণ্ড আকারের একটি শাঁখ। শোনা যায়, প্রায় ১২০ বছর আগে নাকি বর্ধমানের রাজা শাঁখটি সমুদ্রতটে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, দেবীর ইচ্ছাতেই মহারাজ শঙ্খটি পেয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, মহারাজ মহতাব চাঁদ ইতালি থেকে শঙ্খটি আনিয়েছিলেন। আবার এও কথিত আছে, মহারানি নারায়ণী দেবী সমুদ্রতট থেকে এই শঙ্খ সংগ্রহ করেছিলেন। আজও সোনারকালী বাড়িতে নিত্য পুজোয় অতিকায় বিশাল শঙ্খটি ব্যবহৃত হয়। শঙ্খের আয়তন দেখে রীতিমতো তাক লেগে যায়। প্রায় একহাত লম্বা শঙ্খ। ইতালি থেকে আনা শাঁখ, আজও বাজান রাজ পুরোহিতরা। মন্দিরের বিশেষত্বই দেবীর পায়ের কাছে রাখা ওই শঙ্খ। সন্ধ্যা আরতির সময় গোটা কালীবাড়ির মুখরিত হয় শঙ্খের ধ্বনিতে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এমন সুবিশাল শঙ্খ ভূ-ভারতে খুব বেশি মেলে না।
মন্দিরের প্রবেশপথের প্রাঙ্গণে দুটো বড় আকারের পাতকুয়ো রয়েছে। যা খরা ও জলাভাবে কখনও শুকোয় না। আজও মন্দিরের সমস্ত কাজকর্ম এই দুই কুয়োর জলেই করা হয়। শ্বেতপাথরের স্ফটিকের এই মন্দিরের দেওয়ালে বাহারি কারুকার্য ও নকশা খোদাই করা রয়েছে। মন্দিরের প্রবেশ পথে রয়েছে বহু প্রাচীন এক নহবতখানার। মন্দিরের স্থাপত্যরীতিতে ব্রিটিশ ও ইতালিয় স্থাপত্যশৈলীর মেলবন্ধন পরিলক্ষিত হয়।
আজও প্রতিদিন মন্দিরে ভক্তরা আসেন। নিত্যপুজো হয়, সন্ধ্যা আরতি হয়, ভোগ বিতরণ হয়। কার্তিক অমাবস্যায় অর্থাৎ কালীপুজোয় মহাজাঁকজমক সহকারে পুজো হয়। কালী পুজোয় এখানে খিচুড়ি ভোগের সঙ্গে মাছের টকও দেওয়া হয়। মন্দিরে প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ, ফলে বলিদান এখানে বন্ধ। বদলে এখানে চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। আজও পুরোনো রীতি ও ঐতিহ্য মেনে পুজোর আয়োজন করা হয়। রাজ পরিবারের কূলদেবতা হলেন লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ, তাঁর মন্দির রয়েছে, রয়েছে রাধাবল্লভ মন্দিরও, দুটোই রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠা করা। এখানেই অনন্য বর্ধমানের রাজ পরিবার, একই সঙ্গে তাঁরা কালী ও কৃষ্ণের আরাধনা করেন।