আজকের কালী কথায় আমরা পাড়ি দেব হুগলির ব্যান্ডেলে। ঔপনিবেশিক ইতিহাসে সমৃদ্ধ এই প্রাচীন জনপদের পরতে পরতে ইতিহাসের ছোঁয়া। ব্যান্ডেল বহু ধর্মের মিলন ক্ষেত্রও বটে। এখানেই রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী কালী মায়ের মন্দির। মন্দিরটি কোড়লা গ্রামে অবস্থিত এবং কোড়লা কালীবাড়ি নামে পরিচিত। ব্যান্ডেলের কাজিডাঙা হয়ে সরস্বতী নদী পেরিয়েই দেবানন্দপুরের কোড়লা গ্রাম। সেখানেই রয়েছে চারশো বছরের প্রাচীন কালী মন্দির। স্থানীয় মানুষের কাছে এই মন্দির এক জাগ্রত পীঠ। আজ দূরদূরান্ত থেকেও ভক্তরা মন্দিরে আসেন। ভক্তদের বিশ্বাস, সিদ্ধেশ্বরী মায়ের কাছে মন থেকে কিছু চাইলেই, মা মনোবাঞ্ছা পূরণ করবেনই। এই বিশ্বাস থেকেই বহুমানুষ এখানে আসেন। নিত্য পুজো চলে। বিশেষ পুজো হয় কার্তিক অমাবস্যায়, কালী পুজোর রাতে এখানে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়।
এই জাগ্রত কালীবাড়ি ঘিরে রয়েছে জনশ্রুতি। কথিত আছে, ঘোষাল সর্দার নামক এক ডাকাত সর্দার দেবী কালিকার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। মা সিদ্ধেশ্বরী স্বপ্নে ডাকাত সর্দারকে বলেছিলেন, তিনি পুস্করিণীতে আছেন। দেবী কালিকাই নির্দেশ দেন, সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী, পুকুরের পাশেই মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখন কোড়লা গ্রামের মন্দিরে রয়েছে বড় আকারের মাতৃ মূর্তি, সেই মূর্তির পাশেই আজও প্রতিষ্ঠিত ঘোষাল সর্দারের পাওয়া প্রাচীন মূর্তি। মন্দিরের দুই পাশে দুই বাড়ি, যা এলাকায় বড়ো বাড়ি ও ছোট বাড়ি নামে পরিচিত। এরাই মন্দিরের সেবায়েত। তাঁরাই মন্দিরের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে।
গ্রাম্য পরিবেশ ঘেরা এই মন্দিরের আশপাশের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য, আম, জাম, লিচু, বাগান এক অপরূপ শোভার সৃষ্টি করে। আনুমানিক ৪০০ বছর আগে কোড়লা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলত সরস্বতী নদী, যা আজ মৃতপ্রায় নদী, বর্ষার সময়তে তাও জলে কিছুটা পরিপুষ্ট হয়। নদীপথেই ছিল বাণিজ্য কেন্দ্র সপ্তগ্রাম। সেই সময় ওই অঞ্চলে ঘোষাল সর্দার নামক এক দস্যুর দাপট ছিল। স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনিই কোড়লার বৃহৎ পুকুর থেকে সিদ্ধেশ্বরী মাকে তুলে এনে পুকুর পাড়ে প্রতিষ্ঠা করেন, আজ সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দির। কালী পুজোর পাশাপাশি কৌশিকী অমাবস্যায় মন্দিরে মহাসমারোহে পুজো হয়। পৌষ মাসে পৌষ কালী পুজো হয় ধুমধাম করে।
মাতৃ মন্দিরের গর্ভগৃহে অবস্থান করেন দেবী কালিকা। বিগ্রহ বেশ অভিনব, একই মূর্তিতে প্রতি বছর পুজো করা হয়। কেবল প্রতি বছর পুজোর আগে মূর্তি রঙ করা হয়। বৃহৎ মাতৃ মূর্তির পাশেই বিরাজ করেন ডাকাত সর্দারের পাওয়া ছোট্ট কালী মূর্তিটি। গর্ভগৃহে মা সিদ্ধেশ্বরীর গাত্র বর্ণ নীল, পদতলে শ্বেত বর্ণের শিব বিরাজমান। দেবী কালিকা এখানে চতুর্ভূজা, ডান দিকের হস্তদ্বয়ের উপরের দিকের হস্তে অভয়দায়িনী মুদ্রা ও অপর হস্তে বরাভয়দায়িনী মুদ্রায় বিরাজমান, বাম হস্তদ্বয়ের উপরের হস্তে খড়্গ এবং নীচের হস্তে মুণ্ড। দেবী কালিকার পদতলে দেবাদিদেব মহেশ্বর শবরূপী নন, শ্বেতশুভ্র মহেশ্বর মাথায় হাত রেখে অপরূপ ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। মাতৃ মূর্তির উচ্চতা পাঁচফুটেরও বেশি। মায়ের ডান পাশে মায়ের বেদিতেই রয়েছে একটি শিবলিঙ্গ। মায়ের বাম পাশে ছোট্ট সিংহাসনে ঘোষাল সর্দারের স্বপ্নে পাওয়া মায়ের ছোট পাথরের মূর্তি রাখা রয়েছে। তার পাশে বিভিন্ন আকারের নারায়ণ শিলা ও কয়েকটি শ্বেত শিবলিঙ্গ রয়েছে। মন্দিরে কোন বলিদান প্রথা নেই। প্রতি শনিবার, মঙ্গলবার তুলে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। এছাড়াও অন্যান্য দিনও দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হয়। প্রাচীন এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে বড় ঘাট বাঁধানো পুকুর, সেখান থেকেই দেবীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল।
পালা করে করে মন্দিরটির দায়িত্ব সামলায় ঘোষাল পরিবার ও ভট্টাচার্য্য পরিবার, এঁরাই ছোট বাড়ি ও বড় বাড়ি নামে পরিচিত। বাংলা মাস অনুযায়ী ২:১ অনুপাতে মন্দিরের পুজোর দায়িত্ব ভাগ হয় দুই পরিবারে। লোকমুখে শোনা যায়, মায়ের আশীর্বাদে রোগও নিরাময় হয়। ক্রমেই মায়ের মাহাত্ম্য দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। পাল্লা দিয়েই বাড়ছে ভক্ত সমাগম।