হুগলির আঁটপুর, স্বামী বিবেকানন্দর গুরুভাই স্বামী প্রেমানন্দের জন্মস্থান হল আঁটপুর৷ আঁটপুর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল বিবেকানন্দের নেতৃত্বে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পথচলা। এই আঁটপুরেই ধুনি জ্বালিয়ে সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন তাঁরা। আজকের কালী কথায় এই আঁটপুরের এক কালী আরাধনার কথা বলব। আঁটপুরের আনরবাটী গ্রামে বড় কালীর পুজো হয়। কার্তিক মাসে অমাবস্যার আগে চতুর্দশী তিথিতে এখানে আরম্ভ হয় রক্ষাকালীর পুজো। চতুর্দশী তিথিতেই পুজো শুরু হয়, আর ওই তিথিতেই পুজো শেষ করে; সূর্যোদয়ের আগে মায়ের বিসর্জন হয়। পুজোর বয়স আড়াইশো বছরেরও বেশি। আজও রয়েছে পুরনো পুজোর বেদি, এখনও সেই বেদি মাটির তৈরি। সেখানেই পূজিতা হন দেবী, পঞ্চমুণ্ডীর আসনে দেবীর পুজো হয়। রক্ষাকালীর গাত্রবর্ণ নীল। দু'হাতের রক্ষাকালী মূর্তি রয়েছে মন্দিরে। মাতৃমূর্তির উচ্চতা ১৫ ফুট। পুজোর নৈবেদ্যর সময় দেবীকে চিনির সন্দেশ দেওয়ার রীতি রয়েছে। এখনও মন্দিরে বলিদানের চল রয়েছে। কালীর নির্দেশ মেনে আজও মণ্ডপ গড়তে তালপাতা ব্যবহার করা হয়। পাকা মন্দির নির্মাণ করার নির্দেশ নেই।
আঁটপুরে কোনও শ্যামা কালীর পুজো হয় না। গ্রামে কেবল বড়মার পুজো হয়, অর্থাৎ বড় কালীর পুজো। পুজো ঘিরে জনশ্রুতির শেষ নেই।
কথিত আছে, আঁটপুরে একবার মহামারী হয়েছিল। মড়ক শুরু হয়, সে সময় গ্রাম ছেড়ে মানুষজন পালাতে শুরু করে। এমন একটা সময় এসে দাঁড়ায় যে, গ্রামে মৃতদেহ দাহ করার জন্য পর্যন্ত লোক ছিল না। এক গ্রামবাসী জনৈক হরিপ্রবোধ মিত্র, তাঁর ঠাকুরমাকে নিয়ে গ্রাম থেকে চলে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় এক মহিলার সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। সেই মহিলা বলেন, গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে না। ওই মহিলাই তাঁদের পরামর্শ দেন, শবদাহের মাঠে পুজো শুরু করতে হবে। পুজোর পর মহামারী থামে।
ওই গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায়, সরকার, বিশ্বাস, দত্ত, দে-সহ বেশ কয়েকটি পরিবার মিলে পুজো শুরু করে। পুজোর সেবায়েত হয় মিত্র পরিবার। বন্দ্যোপাধ্যায়রা পুজোর পৌরহিত্যের দায়িত্ব নেয়। কালীপুজোর আগের দিন ছেলে কালী, মেজ কালী, নেড়া কালী এবং আরও পাঁচটি কালী পুজো হয়। মূল পুজো গ্রামের বড়মার। অন্য কোনও শ্যামা কালী পুজো হয় না। অসুস্থ থেকে সন্তানহীনা সকলেই মায়ের আশীর্বাদ নিতে আসেন মন্দিরে। কালীপুজোর আগের দিন লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। সকলের বিশ্বাস মা মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন।
এই পুজো ঘিরে আরও এক কাহিনি রয়েছে। ৫০ বছর আগের কথা। জনৈক খোকা রায় বড় কালীর কাছে বাঁশি বাজাতেন। তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। গ্রামে রটে যায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। বাসিন্দারা জানতে পারেন খোকার দেহ লাশকাটা ঘরে পাঠানো হয়েছে। কালীপুজোর আগের দিন খোকা রায়ের বাড়ির দরজায় কেউ আঘাত করে। তারপর খোকার গলা শোনা যায়। স্বামীর আত্মা এসেছে ভেবে ভয়ে দরজা খোলেননি স্ত্রী। খানিক্ষণ পর দেখা যায় খোকা মন্দিরে বসে কালীর সামনে বাঁশি বাজাচ্ছেন। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, বড়কালীর মহিমায় খোকা ফিরে এসেছে। আজও অসুস্থ থেকে সন্তানহীনা, সকলেই মায়ের আশীর্বাদ নিতে আসেন। তাঁদের বিশ্বাস বড়কালীর কৃপায় রোগ নিরাময় হবে, কোলে সন্তান আসবে।