বাংলায় মাত্র ছ'টি মন্দির রয়েছে, যেগুলোর চূড়ার সংখ্যা পঁচিশ অর্থাৎ পঁচিশ-রত্ন। বর্ধমানের অম্বিকা কালনাতে তিনটি ২৫ চূড়ার মন্দির আছে। এছাড়াও হুগলি জেলার সুখাড়িয়া আনন্দময়ী কালী মন্দির, বাঁকুড়া জেলার সোনামুখির শ্রীধর মন্দির ও মুর্শিদাবাদ জেলার নশিপুরের রঘুনাথ মন্দির পঁচিশ চূড়া বিশিষ্ট। বাংলায় কেবলমাত্র একটি কালী মন্দিরই পঁচিশ চূড়া বিশিষ্ট।
মন্দিরে লেখা রয়েছে
'আনন্দময়ী ঠাকুরানী
প্রতিষ্ঠাতা ৺বীরেশ্বর মুস্তৌফী
মন্দির স্থাপিত ১১৭০ সাল।'
মুস্তৌফী বংশের আদিনিবাস ছিল নদিয়া জেলার বীরনগর। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে মুস্তৌফীরা বর্ধমানাধিপতি তিলকচাঁদ বাহাদুরের অধীন তৎকালীন
অবিভক্ত বর্ধমান জেলার অন্তর্গত সুখাড়িয়া গ্রামে চলে আসেন এবং থাকতে আরম্ভ করেন। সুখাড়িয়ার তৎকালীন জমিদার বীরেশ্বর মিত্র মুস্তৌফী অপুত্রক ছিলেন। ১৮১৩ সালে লক্ষ টাকা ব্যয়ে তিনি নির্মাণ করলেন পঁচিশ রত্নমন্দির, কন্যারূপে মন্দিরে স্থাপন করেন আনন্দময়ী কালীর প্রতিমা।
মন্দিরের গর্ভগৃহে বেদিতে কাঠের সিংহাসনে শায়িত থাকেন শিব। শিবের দুটি হাত মাথার দিকে। আনন্দময়ী বাবু হয়ে বসেন শিবের মুখের দিকে মুখ করে। পঞ্চমুণ্ডের আসনে মহাদেবের উপর অধিষ্ঠিতা। মাথায় রুপোর মুকুট, দেবী চতুর্ভুজা। কষ্টিপাথরের বিগ্রহের উচ্চতা প্রায় তিন ফুট। মহাকালী পূজিতা হন ভৈরবী হিসাবে। মা একেবারেই জগৎজননী স্বরূপ। ১১৭০ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসের শুক্ল সপ্তমী তিথিতে মায়ের প্রতিষ্ঠা করা হয়। দীপান্বিতা কালীপুজোয় মায়ের আরাধনা হয়। বলা হয়, মা আনন্দময়ীর তিন বোন, নিস্তারিণী এবং হরসুন্দরী। প্রতিদিন দেবীর নিত্যসেবা হয়। সকাল এবং সন্ধ্যায় আরতি হয়।
জনশ্রুতি রয়েছে, মন্দিরের পাশের পুকুরে নাকি সোনার নোলক পরা মাছ রয়েছে। যা মন্দিরের সমৃদ্ধির প্রতীক।
তিনটিস্তরে মোট ২৫টি চূড়া সজ্জিত রয়েছে মন্দিরে। প্রথমস্তরে প্রতি কোণায় তিনটি করে মোট ১২টি, দ্বিতীয়স্তরে প্রতি কোণা দুটি করে মোট ৮টি, তৃতীয়স্তরে প্রতি কোণায় একটি করে মোট ৪টি এবং শীর্ষে একটি চূড়া রয়েছে। সব মিলিয়ে ২৫ টি চূড়া রয়েছে। সুখাড়িয়ার দেখে মেলে পঁচিশচূড়া আনন্দভৈরবী মন্দিরের, কাছেই আনন্দময়ী দিঘি। মৃণাল সেনের অকালের সন্ধানে ছবিতে এই মন্দিরটিকে দেখা গিয়েছিল। দক্ষিণমুখী আনন্দভৈরবী মন্দিরটি উচ্চতা প্রায় ৭৮ ফুট। জানা যায়, বীরেশ্বর মুস্তৌফি লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে মন্দিরটির নির্মাণ করিয়েছিলেন। প্রস্তর নির্মিত দেবী কালিকা এখানে পূজিতা হন। তিনি শিবের বুকের ওপর বসা অবস্থায় অবস্থান করেন।
জানা যায়, ১৮৯৭ সালে প্রবল ভূমিকম্পে মন্দিরের একেবারে উপরের অংশের পাঁচটি চূড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে পুনর্নির্মাণ করা হয়। মন্দিরের দেওয়ালে রাধাকৃষ্ণ, সিংহবাহিনী-গণেশজননী, রামরাজা ইত্যাদির টেরাকোটা ফলক রয়েছে। কৃষ্ণের বকাসুর বধ, পুতনা বধ, কংস বধ, কালীয় দমন, বাবুবিলাস, গড়গড়াবিলাস, শিবলিঙ্গ পূজা, শিকার দৃশ্য ইত্যাদি ফুটে উঠেছে মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যে।
মন্দিরটির সামনে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর দু-দিকের একটি করে পঞ্চরত্ন এবং পাঁচটি করে আটচালা মন্দির আছে। পূর্বদিকের সারির মন্দিরগুলি কিছুটা হেলে গেছে প্রাকৃতিক কারণে। পশ্চিমদিকের প্রথম পঞ্চরত্ন মন্দিরে গণেশ বিগ্রহ রয়েছে। অন্য এগারোটি মন্দিরে শিব বিরাজ করেন। আটটি কালো এবং তিনটি সাদা শিবলিঙ্গ রয়েছে মন্দিরগুলোতে। আনন্দভৈরবী মন্দির ছাড়াও সুখাড়িয়াতে রয়েছে মুস্তৌফি পরিবারের তৈরি করা নবরত্ন হরসুন্দরী কালীবাড়ি, নিস্তারিণী কালীবড়ি এবং প্রাচীন সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির আছে। তবে আনন্দভৈরবী মন্দির হুগলির অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরাকীর্তি।